জ্বালানি খাতে সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি আর ডলার সংকট ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য সময়মতো এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে না পারা, আমদানিকারকদের পাওনা পরিশোধ করতে না পারায় জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাড়ছে ভর্তুকি ও বকেয়ার পরিমাণ।
এ অবস্থা চলতে থাকলে জ্বালানি আমদানি বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমদানিতে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ১ টাকা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত চাহিদা পূরণে অধিক পরিমাণ জ্বালানি আমদানির ফলে আমদানি ব্যয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য আমদানি ব্যয়কে আরও প্রভাবিত করছে। বিপিসি সাধারণত প্রতি মাসে ১৪-১৫টি এলসির মাধ্যমে প্রায় ৪ দশমিক ৫০ লাখ টন পরিশোধিত এবং ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। গত অর্থবছরের তুলনায় ফার্নেস ওয়েলের চাহিদা প্রায় ৩ লাখ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানি প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের চাহিদা হতে পারে ৪৭৩৩ এমএমসিএফডি, ২০৩০-৩১ অর্থবছরে ৬৯১৬ এমএমসিএফডি ও ২০৪০-৪১ অর্থবছরে ৭৭৫৮ এমএমসিএফডি। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদিত গ্যাস ও আমদানি করা এলএনজি মিলিয়ে সরবরাহের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩০২৯ এমএমসিএফডি, ২০৩০-৩১ অর্থবছরে ৪৬০৮ এমএমসিএফডি ও ২০৪০-৪১ অর্থবছরে ৫২৪৯ এমএমসিএফডি । তবে দেশের ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টি থেকে দৈনিক ২১২৩ মিলিয়ন ঘনফুটের সঙ্গে রি-গ্যাসিফাইড এলএনজি ৭৫২ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ করে দৈনিক ২৮৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান পূরণে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
২০২৩ সালে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে ৫৬টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ২১টি কার্গো আমদানি করা হবে। এর বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৪০টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ১৮টি কার্গো আমদানি করা হয়েছে। এ অর্থবছরে এলএনজি আমদানির বিপরীতে প্রয়োজন হবে ৩২০৯ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত পরিকল্পনা মোতাবেক অবশিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ১৬টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ৩টি এলএনজি কার্গো আমদানি করা হবে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানির মূল্যবাবদ ২৪১ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অপরিশোধিত রয়েছে।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাছে ২১১ দশমিক ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া রয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা অর্থের পরিমাণ ২৯৮ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী, অবশিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ১৬টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ৩টি এলএনজি কার্গো আমদানিতে আনুমানিক ব্যয় হতে পারে মোট ৭৫৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া চলতি বছরের অবশিষ্ট ৪ মাসে দেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস ও কনডেনসেট ক্রয় বাবদ পরিশোধ করতে হবে আনুমানিক ১৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশে আবিষ্কৃত ৫টি কয়লা ক্ষেত্রের মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়া খনি থেকে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া খনি থেকে মোট ১৩ দশমিক ৭২ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া দেশের অন্য সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি করা কয়লার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফার্নেস তেল ও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজেল ও ফার্নেস তেল সম্পূর্ণ রূপেই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ক্রয়, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে প্রায় ৩৩% অর্থ কয়লার মূল্য পরিশোধের জন্য প্রয়োজন হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ডলার সরবরাহ সংকোচনের কারণে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকও অনেক ক্ষেত্রে বিপিসির চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলার সরবরাহ সংকোচনের কারণে বিপিসি প্রান্তে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। বকেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল আমদানি বিঘ্নিত হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরে নির্দিষ্ট সময়ে কার্গো এলেও মূল্য পরিশোধে বিলম্বের কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটি জাহাজে ‘ফিন্যান্সিয়াল হোল্ড’ আরোপ করায় প্রায় ৬০ হাজার টন ডিজেল খালাস সম্ভব হচ্ছে না। পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে ৩২ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে বিপিসিকে।
সংকট নিরসনে বিপিসি তার প্রতিবেদনের সুপারিশে জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে বকেয়া পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক/অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ সরকারি প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় যথাসময়ে এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি আগের মতো বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেছে।
এ দিকে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের স্বল্পতা, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায়, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্রয়-বিক্রয়ের পার্থক্যের জন্য চলতি অর্থবছরে ৩৫ হাজার থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ভর্তুকি বাবদ প্রয়োজন হবে। তবে গ্যাস উত্তোলন দিনে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়লে ঘাটতি ৬ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।
বর্তমানে ডলার সরবরাহ সংকোচনের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য জ্বালানি আমদানির লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলায় বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফুয়েল সাপ্লাই চেইন যথাযথভাবে মেইনটেইন না হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কোনো কোনো সময় জ্বালানি স্বল্পতার কারণে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সংকট নিরসনে পর্যায়ক্রমে পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ১ টাকা বাড়ানো হলে ভর্তুকির পরিমাণ বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা কমবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকট হলেও শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে হলেও জ্বলানি আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, প্রতিবেদনে দেশের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। আমাদের জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেটার খেসারত দিতে হচ্ছে। সংকট সমাধানে এখনই উদ্যোগী না হলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে। এ জন্য আমাদের সামনে জোরেশোরে গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ডলারের সংকট রয়েছে তারপরও জ্বালানি আমদানি বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। জ্বালানির সংকট হলে সবকিছুর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। অন্য খাতের আমদানি কমিয়ে জ্বালানি খাতে ডলার সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
সময়ের আলো/আরএস/