কক্সবাজারের টেকনাফ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় অনেক রোহিঙ্গা সুকৌশলে জন্মসনদ ও বাংলাদেশি এনআইডি তৈরি করে দিনেদিনে বনে যাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। বাংলাদেশি এনআইডি ও জন্মসনদ নিয়ে এসব রোহিঙ্গারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো দেশে। এসব রোহিঙ্গারা কোথাও যেতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে না। এমনকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি এনআইডি তৈরি করে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের নেথ্যে কাজ করছে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী নেতা ও কথিত সুশীলরা।
বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ ও এনআইডি তৈরিতে মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে কতিপয় জনপ্রতিনিধি। মূলত জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষরেই রোহিঙ্গারা দিনেদিনে বনে যাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বনে যাওয়ার সুযোগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে না গিয়ে বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাস করতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে এনআইডি তৈরি করতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। এতে করে প্রকৃত বাংলাদেশিদের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে সেবা নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বসবাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে কুটির জোর বাড়াচ্ছে। দিনদিন তারা শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছে। কতিপয় জনপ্রতিনিধিরাই রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরিতে স্বাক্ষর করে তাদের শক্তিশালী করছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। যেসব জনপ্রতিনিধি ভোটার হওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের ডকুমেন্টস তৈরি করে দিচ্ছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, আব্দুর রহমান নামে এক রোহিঙ্গা ছেলে জন্মসনদ তৈরি করে এনআইডি তৈরির প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যোগাড় করেছে। তার এসব ডকুমেন্টস যোগাড় করতে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় নুর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
বিশেষ করে আব্দুর রহমান নামে এই রোহিঙ্গার সমস্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছে হ্নীলা ইউনিয়নের মহিলা সদস্য (১,২,৪) রাহমা আক্তার। স্থানীয় চৌকিদার ও মহিলা মেম্বার রাহমা আক্তারের স্বাক্ষরেই আব্দুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা জন্মসনদ তৈরি করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভোটারপ্রার্থী আব্দুর রহমান রোহিঙ্গা শাহ আলম ও স্থানীয় সালেহা বেগম দম্পতির ছেলে। তারা হ্নীলা ইউপির ১ নং ওয়ার্ডের পানিরছড়া এলাকায় বসবাস করলেও ভোটারের যাবতীয় ডকুমেন্টসে স্থান পরিবর্তন করে একই ওয়ার্ডের আলী আকবর পাড়ার ঠিকানা ব্যবহার করেছে।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত আব্দুর রহমানের বাবা শাহ আলমের ফোনে জানতে চাইলে ভুল নাম্বার বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
অভিযুক্ত আব্দুর রহমানের মুঠোফোনে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা রোহিঙ্গা নয়, তার বাবাকে তারা ছোটকাল থেকেই দেখেনি। এসব তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন।
হ্নীলা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বশির আহমদ বলেন, ছেলেটির মা আমার কাছে এসেছিল, তারা রোহিঙ্গা হওয়ায় কাগজে স্বাক্ষর করিনি। পরে কিভাবে কার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়েছে তিনি জানেন না বলে জানান।
অভিযোগ উঠেছে, মহিলা মেম্বার রাহমা আক্তার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা পরিবারের লোকজনের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছে। ইউপি সদস্য রাহমা আক্তারের এমন কর্মকান্ডকে দেশদ্রোহিতার শামিল বলে দাবি করেছেন স্থানীয় সুধী ও শিক্ষিত সমাজ।
সংরক্ষিত ইউপি (১,২,৪) রাহমা আক্তারের বিরুদ্ধে এধরণের নানান অনৈতিক কাজের অভিযোগ ইতোপূর্বেও ছিল। তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থার দাবি জানান সচেতন মহল। অন্যথায় - ইউপি সদস্যদের পদ ব্যবহার করে তিনি আরও অনৈতিক কাজ করবেন এবং রোহিঙ্গাদের ভোটারের কাগজসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টস করে দিয়ে নানাপ্রকারের অনৈতিক সুবিধাভোগে মরিয়া হয়ে ওঠবেন বলে জানান সুধী সমাজ।
স্থানীয় নাগরিক ও কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক এহসান উদ্দিন বলেন, যেসব জনপ্রতিনিধি এধরণের গর্হিত কাজ করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। এসব কাজ অবশ্যই দেশদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের কেন স্বাক্ষর দিয়েছেন জানতে চাইলে মহিলা ইউপি সদস্য রাহমা আক্তার স্থানীয় চৌকিদারের উপর দোষ চাপিয়ে স্বাক্ষর দেয়ার কথা স্বীকার করে মুঠোফোনে বলেন, সম্পূর্ণ দায়িত্ব চৌকিদারের, চৌকিদারের স্বাক্ষর দেখেই তিনি স্বাক্ষর দিয়েছেন বলে জানান এবং বিস্তারিত জানতে প্রতিবেদককে তার বাড়িতে যেতে বলেন।
কেবলই ইউপি সদস্য রাহমা নয়, এভাবেই টেকনাফের সাবেক ও বর্তমান অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ তৈরি ও এনআইডি তৈরিতে স্বাক্ষর দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষরিত সেসব ডকুমেন্টস দেখিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি এনআইডি ও জন্মসনদ তৈরি করে নিচ্ছে এবং সরকারি বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে।
এমনকি উলা মিয়ার পুত্র সৈয়দ আলম ও নুর মোহাম্মদের পুত্র ছিদ্দিক আহমদ নামে দুইজন রোহিঙ্গা প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও নিয়েছে এবং বিডব্লিউবি এর ৩০ কেজির চালের সুবিধাও ভোগ করছে বলে জানা গেছে । কতিপয় জনপ্রতিধিদের কারণেই রোহিঙ্গারা এসব সরকারি সুবিধা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাই সেসব রোহিঙ্গা দরদি জনপ্রতিনিধিকে বিচারের মুখোমুখি করার জোর দাবি ওঠেছে।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা ভোটারের বা জন্মসনদের কোনো ফাইল আসলেই আমি আটকিয়ে রাখি, কিছুদিন আগে আব্দুর রহমান নামে এক রোহিঙ্গা ছেলের ভোটার ফাইল আটকে রেখেছি। যেহেতু টেকনাফ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা, তাই স্থানীয় চৌকিদার ও জনপ্রতিনিধিদের কোনোধরণের লোভে না পড়ে রোহিঙ্গা ভোটার ঠেকাতে সোচ্চার ও সজাগ থাকতে হবে বলে আমি মনে করি।
সময়ের আলো/জিকে