অসময়ে টানা কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় হাতছানি দিচ্ছে বন্যা। কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। কুড়িগ্রামে বৃষ্টিপাতের ফলে জেলা শহরের হাসপাতালপাড়া, ফায়ার সার্ভিস, হাটিরপাড় ও নিমবাগান এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দিনাজপুর শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত। অনেক নিচু এলাকার বাড়িঘরে প্রবেশ করেছে বৃষ্টির পানি। রংপুরে মিঠাপুকুর উপজেলায় টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ফসলের খেত। এতে শস্যভান্ডার খ্যাত এই উপজেলার কৃষকদের চোখে-মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে গত দুদিন থেকে অবিরাম বর্ষণে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে নদ-নদীর পানিও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে নিম্নাঞ্চলের কৃষকরা দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। বিপাকে পড়েছে এখানকার শ্রমজীবী মানুষরা। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুরসহ কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে পারছেন না। বৃষ্টিপাতের ফলে জেলা শহরের হাসপাতালপাড়া, ফায়ার সার্ভিস, হাটিরপাড় ও নিমবাগান এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, জেলায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৯ মিলিমিটার। এ ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় জেলার কোথাও কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাতে সম্ভাবনা রয়েছে। কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার শমসের আলী বলেন, সকাল থেকে বৃষ্টি। কাজ-কাম বন্ধ। টাকার চিন্তায় কিছু ভালো লাগে না। রাত পোহালে কিস্তি। ঘরে নেই বাজার-সদাই। খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। এভাবে বৃষ্টি হলে মানুষের চলাফেরা, কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে যাবে। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের রিকশাচালক আখের আলী বলেন, গতকাল সারা দিনে মাত্র ৩০০ টাকা ভাড়া মারছি। তা দিয়ে কিস্তি মিটাইছি। বাজার করার কোনো টাকা নেই। কুড়িগ্রাম রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, আগামী আরও দুদিন এ বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
দিনাজপুর : টানা ভারী বৃষ্টিতে দিনাজপুরের জনজীবন স্থবিরতা বিরাজ করছে। ভারী বর্ষণে জনজীবন স্থবির এ ছাড়াও জেলার প্রতিটি নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি। যা আগামী ৪-৫ ঘণ্টায় বিপদসীমা অতিক্রম হওয়ার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুর জেলায় বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ১৫৯ মিলিমিটার। আরও পাঁচ দিন চলবে এ বৃষ্টি জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে দিনাজপুর শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত। আবার অনেক নিচু এলাকার বাড়িঘরে প্রবেশ করেছে বৃষ্টির পানি। এতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে শহরের জনজীবন। বিশেষ করে শহরের উপশহর, বালুবাড়ী, শেখপুরা, চাউলিয়াপট্টি, লালবাগ, রামনগর, বালুয়াডাঙ্গা, মিশনরোড এলাকার রাস্তাগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। ঘর থেকে বের হতে পারছেন না কর্মজীবী মানুষরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুরে প্রধান তিনটি নদী আত্রাই, ইছামতী ও পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। এতে নদীর তীরঘেঁষা নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই হতে পারে বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দিনাজপুরের আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এলাকার অনেকাংশ ডুবে গেছে। এ ছাড়াও শহরের বুক দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীসংলগ্ন শহরের নিম্নাঞ্চল দপ্তরীপাড়া, বালুয়াডাঙ্গা, হঠাৎপাড়া, লালবাগ, রাজাপাড়ার ঘাট, মাঝাডাঙ্গা, বাঙ্গীবেচা ব্রিজ এলাকা, নতুনপাড়ার প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মো. সিদ্দিকুর জামান নয়ন সময়ের আলোকে জানান, জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর মধ্যে আত্রাই আর পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আসাদ সময়ের আলোকে জানান, দিনাজপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৯ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টি আগামী ৪-৫ দিন আরও চলবে।
রংপুর : অসময়ের ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে রংপুর নগরীর নিম্নাঞ্চল। নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষরা। সড়কে যানবাহন চলাচল কিছুটা কমেছে। অনেক মার্কেটে খোলা হয়নি দোকানপাট। কাজের আকালে বিপাকে রয়েছেন দিনমজুর ও শ্রমিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর নগরীর লালবাগ, খামার মোড়, নেসকো গেট, নূরপুর, কামাল কাছনা, মাহিগঞ্জ, বোতলা, নিউ জুম্মাপাড়া, পূর্ব জুম্মাপাড়া, তাজহাট, বাবুপাড়া, মহাদেবপুর, কামারপাড়া, শালবন, মিস্ত্রিপাড়া, দর্শনা, আশরতপুর, ধাপ এলাকা, মুন্সিপাড়া, হনুমানতলা, মুলাটোল, মেডিকেল পাকার মাথা ও জলকরসহ বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
রংপুর নগরীর মোস্তফা সাব্বির পিয়াল জানান, কেরামতি মসজিদের পেছনে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকেই উঁচু জায়গা বা স্কুলের ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। দেখা গেছে শুকনো খাবারের সংকট। কয়েকটি স্কুলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ ঠিকমতো চলাচল করতে পারছে না। ড্রেনের মুখগুলো ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হওয়াতে এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের নীলফামারীর সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ ৪১৫.৪ মিলিমিটার এবং রংপুরে ১৬২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুরে ৩১৮.৪ মিলিমিটার, নীলফামারীর ডিমলায় ২০৪.৭, পঞ্চগড়ে ১৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ মৌসুমে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আরও দুদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় গত শনিবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ফসলের খেত। এতে শস্যভান্ডার খ্যাত এই উপজেলার কৃষকদের চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও খেটে-খাওয়া মানুষ।
উপজেলায় সবজির জন্য বিখ্যাত রানীপুকুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া, আফজালপুর, তাজনগর, ভক্তিপুর, বলদীপুকুর হিন্দুপাড়া গ্রামের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে তাদের আমনসহ বিভিন্ন সবজির ফসলের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের পুকুরের মাছ বের হয়ে গেছে। ফলে কৃষিজীবীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এভাবে বৃষ্টি চলমান থাকলে আর পানি নেমে না গেলে বন্যার আশঙ্কা করছেন তারা। একইভাবে অলস সময় পার করছেন অটোরিকশাচালক, ছোট দোকানদার এবং স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
সময়ের আলো/আরএস/