ফলের পাইকারি আড়ত পুরান ঢাকার বাদামতলী। দেশের বৃহত্তম এই আড়তে দেশি-বিদেশি হরেক রকম ফল মেলে। অন্যতম আকর্ষণ নিলাম। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাবেচা।
রোববার গিয়ে দেখা যায়, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের পদচারণে মুখরিত বাদামতলী। আড়তদারদের যেন দম ফেলার সময় নেই। হাঁকডাকে চলছে বিক্রি। এক পাশে দেখা গেল ফল নামছে সারি সারি ট্রাক থেকে। খুচরা বিক্রেতারা ফল কিনে মিনি ট্রাক কিংবা লঞ্চে তুলে নিচ্ছেন। কেউ কেউ ফল কিনে তুলছেন ভ্যান কিংবা রিকশায়। খুচরা বিক্রেতারা বেশিরভাগই এসেছেন রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে।
ফুটপাথে ফলের ব্যবসা করেন রোমান মিয়া। প্রতিদিন বাদামতলী আড়ত থেকে ফল কেনেন। তিনি জানান, ভ্যানে করে ফল বিক্রি করেন সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালের গেটের সামনে। মিরপুর ১০ থেকে বাদামতলীতে ফল কিনতে আসেন ব্যবসায়ী মো. সোহেল মিয়া। তিনি বলেন, আজ এখান থেকে যে কমলা ২৬০ টাকা কেজি দরে কিনেছি, মিরপুরে নিয়ে তা ৩২০ টাকার নিচে বিক্রি করলে লাভ হবে না। বাদামতলী থেকে মিরপুরের দূরত্বও বেশি। দূরত্ব যত বেশি দামও তত বেশি। কারণ আসা-যাওয়ার খরচ বেশি। একটা ভ্যান ভাড়া করলেই ১ হাজার টাকা দিতে হয়। আর খাওয়ার খরচসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।
রোববার বাদামতলী ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে, এক কার্টন (১৫ কেজি) মাল্টা ৩৩০০-৩৬০০ টাকা, এক কার্টন আপেল (১৮-২০ কেজি) ৩৩০০-৫০০০ টাকা, এক কার্টন আঙুর (৬ কেজি) ২১০০-২৬০০ টাকা, এক কার্টন নাশপাতি (৯ কেজি) ১৭০০-২৮০০ টাকা, এক কার্টন আনার (১৬ কেজি) ৪৯০০-৫৫০০ টাকা, এক কার্টন নাগফল (৯ কেজি) ৩৫০০-৪২০০ টাকা ও বেদেনা এক কার্টন ৬০০০-৭০০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতিটি ফলের দামে বিস্তর তফাত। খুচরা বাজারে মাল্টা ৩০০, কমলা ২৮০-৩০০, আঙুর ৪৫০-৪৮০ ও নাশপাতি ২৬০-২৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। অর্থাৎ খুচরা বিক্রেতারা প্রতিটি ফলের কেজিতে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নিচ্ছেন।
বাদামতলীর আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বিদেশি ফলের সিংহভাগ আমদানি হয়। এর মধ্যে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভুটান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড থেকে বেশি বিদেশি ফল আমদানি হয়। দেশে যে ফল বেশি উৎপাদিত হয়, সেটার ওপর কর তুলনামূলক কম। কিন্তু বিদেশি ফল আঙুর, আপেল, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলের ওপর কর বেশি হওয়ায় আমদানিও কমেছে এবং দামও বাড়তি। আর ফলের দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে। মান, পরিমাণ এবং ফলের ওজন কোম্পানি ও ধরন ভেদে কিছুটা তারতম্য হয়।
ভারত থেকে আপেল আমদানি করেন বাদামতলীর মেসার্স ফারিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শাহজালাল বেপারি। তিনি বলেন, ভারত থেকে আসা গাড়িতে ১ হাজার বা তার কমবেশি কার্টন ফল থাকে। এই গাড়ি বাদামতলী আসতে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। কমলার গাড়ি আনতে ২২ লাখ টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ ২০ লাখের নিচে কোনো ডিউটি পড়ে না। অথচ এক বছর আগে এই ফল আনতে ৮-৯ লাখ খরচ হতো। ডলার সংকটে বিদেশি ফল আনতে সরকারের ভ্যাট বাড়িয়েছে। এতে ফল আনতে খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে।
দেশে এক বছরের ব্যবধানে আপেল, মাল্টা ও আঙুরসহ বিদেশি ফলের আমদানি কমেছে বলে জানান আফিয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জাবেদ হোসেন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ভ্যাট বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে শতভাগ মার্জিন দিয়ে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। যারা ঘুষ দিতে পারেন এবং যাদের সিআইপি উপাধি আছে, তারা শুধু এলসি খুলতে পারেন। কিন্তু আমি-আপনি এলসি খুলতে গেলে জীবন বের হয়ে যায়। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে চায়না আপেল আসে। আমরা সেখান থেকে আমদানি করি। আজকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে এক কার্টন হাইকোয়ালিটির আপেল কিনেছি ৩৬০০ টাকায়। প্রতি কার্টন গাড়ি ভাড়া, লেবার খরচসহ ৩৭০০ টাকা পড়েছে। আর আমরা বিক্রি করি ৩৭৫০ কিংবা ৩৮০০ টাকা। এর মধ্যে আবার কিছু নষ্ট হয়। অনেক সময় লোকসানও হয়। এই আপেল খুচরা বাজারে ৪ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হবে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি পড়বে ২২০-২৩০ টাকা। ফলে সাধারণ মানুষ এখন ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
ফলের বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রফতানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির এক নম্বর সদস্য মো. সেলিম সময়ের আলোকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে বিদেশি ফলের আমদানি কমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশ। একসময় ফল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ ছিল এখন কিছুটা চালু রয়েছে। আগে ১০ শতাংশে এলসি খোলা যেত এখন শতভাগ মার্জিন দিয়েও খোলা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, গত বাজেটে শুধু প্রতি কার্টনে আপেলের ওপর ভ্যাট বেড়েছে ৫০৮ টাকা, মাল্টার ওপর বেড়েছে ৩৮৪ টাকা। সুতরাং খুচরা ও পাইকারিতেও দাম বেড়েছে। আমরা দিনে ১০০ কার্টন বিক্রি করতে পারলেও এখন ৭০ কার্টনও বিক্রি হয় না। আর খুচরা বিক্রেতাদের কোনো দোষ নেই। তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের ফল কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে। আর দোকান ভাড়াসহ সবকিছুরই খরচ বেড়েছে। যদি কম দামে কিনতে পারত তা হলে ক্রেতারাও কম দামে কিনতে পারত বলেও মনে করেন তিনি।
সময়ের আলো/আরএস/