আজ থেকে শতবর্ষের আগের কথা। অর্থাৎ ১৯২১ সাল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারাবরণ করেন। সে সময় তারই ‘বাঙলার কথা’ নামে পত্রিকায় কবিতা লেখেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর সেই কবিতাটি হচ্ছে- ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। কবিতাটি লেখা হতো কি না জানি না, যদি সে সময় চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে কবির কাছে লেখা না চাইতেন। কবি মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই কবিতাটি লিখে দেন। এই কবিতায় সুর দিলেন তিনি নিজেই। আর যখন দিলেন তখন তিনি ছিলেন বন্দি। এই কবিতা লেখার মাত্র তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই কবিতাটি প্রকাশ হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে। এই বইটি প্রকাশের অল্পদিন পরেই তা নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। বইটি আবার প্রকাশিত হয় স্বাধীন ভারতে। যখন কবি নজরুল বাক্রুদ্ধ।
যেটি নিয়ে এত আলোচনা তা হচ্ছে, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি। কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি প্রথম রেকর্ড করেছিলেন গিরিন চক্রবর্তী। পরে এই গানটি অনেকে একক বা সম্মিলিতভাবে গেয়েছেন। গানটি ১৯৭০ সালে জহির রায়হান তার পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংযোজন করেছিলেন। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের এই গান বাঙালিদের উদ্দীপ্ত করেছে।
দীর্ঘদিন পর এই গানটি সংযোজন করা হয়েছে বলিউডে হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘পিপ্পা’ ছবিতে। তবে গানটির সুর বিকৃতি নিয়ে এখন চলছে সমালোচনার ঝড়, দেশে ও বিদেশে। গানটিতে অস্কারজয়ী ভারতের সংগীত পরিচালক এ আর রহমান যে সুর সংযোজন করেছেন তা নিয়েই মূলত এই সমালোচনার ঝড়। এ আর রহমান বিশ্বখ্যাত নন্দিত একজন সুরকার। এই সুরকার নজরুলের গানের সুর বিকৃত করবেন তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিভিন্ন মাধ্যমে সুর বিকৃতি নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বিভিন্ন সংগীতজ্ঞ ও গুণী শিল্পীরা।
উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীত-পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী কলকাতার সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার ভালো লাগেনি। ওর মতো অত্যন্ত সুপরিচিত সুরকারের কাছে আমরা এটা আশা করি না। তিনি বলেছেন, এ আর রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। ওর কাছে নিশ্চয়ই তথ্য ছিল বলেই সাহস পেয়েছে। আসলে আমাদেরও প্রচুর ভুল রয়েছে। তবে তিনি শেষমেশ বলেছেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে কিছুদিনের জন্য উত্তাপ থাকে। কিন্তু তারপর মানুষ ভুলে যায়। তিনি নজরুলের গান সম্পর্কে উল্লেখ করেন, সংগীতের বহু ক্ষেত্রে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তুলনায় নজরুলের অবদান বেশি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে ‘পিপ্পা’ ছবিতে নজরুলের এই গানটি ব্যবহার করার জন্য কাজী নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর কাছে গানটির স্বত্ব নেন ছবির প্রযোজক। সে সময় ছবির প্রযোজকের সঙ্গে দুই লাখ টাকার চুক্তি হয়। চুক্তিপত্রে সাক্ষী হিসেবে সই করেন কল্যাণী কাজীর ছেলে অনির্বাণ। এর আগে কল্যাণী কাজীর সঙ্গে প্রযোজকের কথা হয়। প্রযোজকের কাছ থেকে যখন শুনতে পান এই ছবির পরিচালক এ আর রহমান, তখনই ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ছবিতে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সুর পরিবর্তনের বা কথা পরিবর্তনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমতি দেওয়ার পর কাজী পরিবারের পক্ষ থেকে গানের চূড়ান্ত সংস্করণের বিষয়টি শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গানটি আর শোনা হয়নি। কেন হয়নি, তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মূলত করোনার কারণে ছবির মুক্তি পাওয়ার দিনক্ষণ পিছিয়ে যায়। এরপর গত মে মাসে মারা যান কল্যাণী কাজী। তারপর বিষয়টি সবার অগোচরে চলে যায়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে চুক্তিতে কী ছিল? অনির্বাণ ছাড়া আর কেউ জানতো কি না এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে অনির্বাণের দাবি, বড়মাপের কাজ ছিল বলেই পরিবারের সব সদস্যকে জানানো হয়েছে। কল্যাণী কাজীর মেয়ে অনিন্দিতা বেঁচে থাকলেও গত দু’বছর তার মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এখন গানটির সুর বিকৃতি নিয়ে কাজী পরিবারের পক্ষ থেকে লৌহ কপাট-এর স্বত্ব ও চুক্তিপত্র প্রকাশ্যে আনার দাবি করছেন নজরুল পৌত্রী খিলখিল কাজী। তিনি ভারতের গণমাধ্যমকে বলেছেন, কেউ দাদুর গান ব্যবহার করলে আমরা রেকর্ডিং না শুনে ছাড়পত্র দিই না। এখন ‘কারার লৌহ কপাট’ নিয়ে তার কথা হচ্ছে, যা হয়েছে তা নজরুল ইসলামকে নয়, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি জাতিকে অপমান করা হয়েছে। অনির্বাণের সহোদর কাজী অরিন্দম দাবি করেছেন, লোকে বলছে আমরা টাকা নিয়ে দাদুর গান বিক্রি করেছি। এটা অসম্মানজনক। চুক্তির বিষয়ে আমি পুরো অন্ধকারে ছিলাম। আমার মাও তখন বৃদ্ধ। ইংরেজিতে লেখা চুক্তির খুঁটিনাটি দায় দাদাকে (অনির্বাণ) নিতে হবে।
নজরুল গানের সুর বিকৃতি নিয়ে এ আর রহমানকে বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতের গণমাধ্যম। তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখনও কোনো সাড়া মেলেনি। বরং পিপ্পা ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যা কিছু করা হয়েছে তা আইনগত সব দিক রক্ষা করেই করা হয়েছে।
ক্ষমা চাইল ‘পিপ্পা’ টিম : কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের বিতর্কের মাঝে সোমবার অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়ে ক্ষমা চাইল ‘পিপ্পা’ সিনেমার প্রযোজনা সংস্থা রায় কাপুর ফিল্মস। তাদের বক্তব্য, স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়মবিধি মেনেই তারা কাজ করেছে। গানের লিরিকের লাইসেন্স চুক্তি মেনেই গানটির রিমেক করা হয়েছে বলে দাবি ‘পিপ্পা’ টিমের। তাদের বক্তব্য, লাইসেন্স চুক্তিতে স্বাক্ষর রয়েছে কল্যাণী কাজীর ও সাক্ষী হিসেবে অনির্বাণ কাজীর স্বাক্ষর রয়েছে। চুক্তির শর্তাবলি অনুযায়ী, এই নজরুলগীতির লেখা অপরিবর্তিত রেখে নতুন সুর দেওয়ার অনুমতি রয়েছে বলেই দাবি পিপ্পা টিমের। পিপ্পা টিম বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে সংগীত জগতে, সমাজ ও রাজনীতিতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি ও গানটির আসল সুরের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়ের জন্য যারা সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের কুর্নিশ জানাতেই এই গানটি বানানো হয়েছে।’
সবশেষে ওই বিবৃতিতে লেখা হয়, ‘আমরা মূল গানটিকে ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারও আবেগে আঘাত করে থাকে, তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যশোরের চৌগাছার গরিবপুর এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করেছিল ভারতীয় সেনারা। সে সময়ের যুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমা ‘পিপ্পা’ বানিয়েছেন বলিউড নির্মাতা রাজা কৃষ্ণা মেনন।
সময়ের আলো/জেডআই