
হাসান আজিজুল হক তার প্রথম উপন্যাস ‘বৃত্তায়ন’ লিখেছিলেন ১৯৬০ সালে, লেখক-জীবনের শুরুতেই, কিন্তু সেটিকে বহুদিন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেননি। কেন দেননি সেই ব্যাখ্যা তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বহুদিন পর। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে উপন্যাসটি সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলা যাক।
হাসানের গল্পের যে বিষয়-আশয় এবং লেখক হিসেবে তার যে ইমেজ-সমাজ-সচেতন, রাজনীতি-সচেতন, রূঢ় বাস্তবতার রূপকার ইত্যাদি-তার সঙ্গে এই উপন্যাস একেবারেই যায় না। ষাটের দশকে এ-দেশের সাহিত্যে পশ্চিমা আধুনিকতার ঢেউ এসে পৌঁছেছিল। মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা, জীবনবিমুখতা ইত্যাদিকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছিল; ভেঙে দেওয়া হচ্ছিল যৌনতা সম্পর্কে সব ট্যাবু; প্রচলিত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে করা হচ্ছিল তীব্র আঘাত। ‘বৃত্তায়ন’ সে ধরনেরই উপন্যাস। নামহীন প্রধান চরিত্রই এ উপন্যাসের কথক, যে সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার কিছুই মানে না, এমনকি স্ত্রী লিলির সঙ্গে তার সম্পর্কটিকেও সে মনে করে স্রেফ অভিনয়, যদিও তাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে সে, বিয়ের আগে থেকেই শারীরিক সম্পর্কের নিয়মিত চর্চার ফলে মেয়েটির শরীরও তার কাছে হয়ে গেছে ব্যবহৃত সামগ্রীর মতো পুরনো। তবু যেহেতু তাকে সামাজিক জীবন যাপন করতে হয়, একইসঙ্গে তার আছে শরীরের জান্তব চাহিদা, অতএব তাকেও ভালোবাসার কথা বলতে হয়, সংসার-যাপন করতে হয় এবং সেজন্য তাকে সবসময় পরে থাকতে হয় সৌজন্য এবং ভদ্রতার মুখোশ। সে অনুভব করে, এই সবকিছুর মধ্যে আছে এক দুর্বহ ক্লান্তি, একঘেয়েমি এবং বিবমিষা; কিন্তু তা সত্ত্বেও এর কোনো কিছুকেই ঝেড়ে ফেলতে পারে না সে।
এরকম এক সময়েই দৃশ্যপটে হাজির হয় তার বন্ধু তৌফিক। কলেজে একসঙ্গে পড়তো তারা। তখন তৌফিকের চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল, মানুষের ওপর অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল, বুকভরা প্রেম ছিল; কিন্তু জীবন তাকে ক্ষমা করেনি, তাকে কাক্সিক্ষত জীবন-যাপন করার সুযোগ দেয়নি সমাজ এবং এখন সে পরিণত হয়েছে এক আদিম বন্য মানুষে। একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং একজন লোককে খুন করে সে পালিয়ে এসেছে, আশ্রয় নিয়েছে এখানে। তৌফিকও তার বন্ধুর মতোই সমাজ ও সভ্যতাকে ঘৃণা করে, মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় আস্থা রাখে না, কিন্তু কথকের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো এই যে, কথক নিজের অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারে না, তাকে অভিনয় করে যেতে হয়, অন্যদিকে তৌফিক ওসব ভদ্রতার ধার ধারে না, তার যা ইচ্ছে তা-ই করে। সে যেহেতু খুন করে এসেছে, একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধী, কথক তাকে নিজের বাড়িতে জায়গা দিতে চায় না। কিন্তু তৌফিক তো বন্য, স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সে এখানেই থাকবে। তার এই আগমনকে সহজভাবে নেয় না লিলি, এ নিয়ে কথকের সঙ্গে তার মনোমালিন্যও হয়, কিন্তু উপন্যাসের একপর্যায়ে উন্মোচিত হয় এই সত্য যে, কথকের অনুপস্থিতিতে লিলি তৌফিকের কাছে যায় এবং মিলিত হয় কিংবা তার আগ্রাসী যৌন-তাড়নায় পিষ্ট হয়।
ব্যাপারটা যখন কথক বুঝতে পারে, তখন সে কী ভাবে দেখুন : ‘জীবনটা একটা মহান জিনিস এবং অসুবিধার সৃষ্টি না করে বৈচিত্র্যে, স্বাদে, স্পর্শে, গন্ধে তাকে সার্থক করে নেওয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।’ অর্থাৎ, স্ত্রীর এই গোপন অভিসারকে সে অনুমোদন করে, যদিও তা প্রকাশ করে না। অতঃপর একসময় বিষয়টি সামনে চলে আসে, লিলি প্রায় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, ভেঙে পড়ে, কাঁদে, চেঁচায়, আর কথক তাকে বলে : ‘হ্যাঁ সব জানি আমি। তৌফিকের সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি করেছ শুয়েছ তুমি। জানি। কিন্তু আমার কী এসে যায়? তুমি তো আমার সঙ্গেও বিছানা ভাগ করে নিতে আপত্তি করনি। তোমার দেহটা তোমার। মাঝে মাঝে আমাকে ব্যবহার করতে দিয়ে কৃতার্থ কর। সমাজ না দেখলে, গোলমাল না করলে আরেকজনকে যদি ব্যবহার করতে দাও আমার কী ক্ষতি?’ এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনো স্বাভাবিক-সামাজিক মানুষের থাকার কথা নয়, থাকে না। দাম্পত্য জীবনকে সামাজিকভাবে পবিত্র হিসেবেই গণ্য করা হয়। কথক সেই সমাজকে ঘৃণা করলেও এড়াতে পারে না, আর তাই ‘সমাজ না দেখলে’ কথাটি এসে যায়। কিন্তু স্ত্রীর দেহ অন্য কেউ ব্যবহার করলে আপত্তি না থাকার ব্যাপারটাও ঠিক সহজলভ্য নয়। কথকের এই মনোভঙ্গি আমাদের কাছে তাই অচেনা।
লিলি একসময় স্বামীর কাছে সব স্বীকার করে এবং বলে, তাকে তৌফিকের কাছে যেতেই হবে, না গিয়ে উপায় নেই- ‘কাল যখন তুমি বাইরে যাবে, দুপুরের রোদে সে বাইরে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ছাগল-ছানা যেমন অজগরের মুখে গিয়ে ঢোকে আমি তেমনি ওর ঘরে গিয়ে ঢুকব। সে তার পাহাড়ের মতো ভারী দেহটা আমার দেহের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলবে, দুর্গন্ধভরা মুখটা আমার মুখের ওপর নামিয়ে আনবে, আমি তোমার ধ্যান করব আর সে যতক্ষণ পরে খুশি আমাকে ছেড়ে দিলে পাক খেতে খেতে ঘরে ঢুকব। দিনের পর দিন আমি এই করব-সে যেখানে যাবে আমার সেইখানে যেতে হবে। কী নিদারুণ ভয় আমার!’ লিলির এই স্বীকারোক্তির পর কথকের অনুভূতি-‘তৌফিক আমার ওপর জেতে এই জায়গায়। প্রকৃতির অদৃশ্য চলমান জন্তুর আদিম শক্তি তার মধ্যে। আমি পঙ্গু, ভঙ্গুর, অসহায় তার কাছে।’
কিন্তু লিলি কেন যায় তৌফিকের কাছে? কেন যেতেই হবে তাকে? স্বামীকে ছাড়া সে আর কাউকে ভালোবাসে না, তবু কোন সে গোপন কারণে সে তৌফিকের গ্রাসের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়? তাহলে কি লিলিও একঘেয়েমি এবং ক্লান্তিতে ভোগে? তৌফিকের ভেতরকার ‘প্রকৃতির অদৃশ্য চলমান জন্তুর আদিম শক্তি’র টানে কি আদিম-বন্য জীবনের স্মৃতি ফিরে আসে লিলির ভেতরে? এই মনুষ্যসৃষ্ট সভ্যতার ক্লান্তি, একঘেয়েমি, বিরক্তির চেয়ে ওই জান্তব বন্যতাই তার কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় আর আপন মনে হয়?
আর তৌফিক? যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, তার চিন্তার জগৎটি কেমন? সেটিও জানা যায় তার লেখা থেকে-
‘খরগোশের মতো ভীরু আর নির্বোধ কোমল জীবটা প্রত্যেকদিন দুপুরে আসে!
যখন বোকার মতো এক পা এক পা করে ঘরে ঢোকে, এদিক-ওদিক চায় আর বলে সে না এসে পারে না, তখন আমার জিঘাংসাবৃত্তি কী যে আনন্দিত হয় আমি বলতে পারি না। মেয়েটি বলে সে নাকি আমাকে ঘৃণা করে। কিন্তু তাতে কী? আমি সমস্ত জগৎকে ঘৃণা করি, আমি সমস্ত মানুষকে ঘৃণা করি।
কিন্তু ওই ছোট্ট জীবটাকে আমার বোঝানোরই প্রয়োজন নেই যে সে আমাকে ঘৃণা করলে আমার কিছুই এসে যায় না। মানুষ নিজের জীবন দিয়ে, দীর্ঘ সময়ে বোকামি, হীনম্মন্যতা, স্বার্থপরতা আর অন্যান্য যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি দিয়ে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে আমি তাতে থুতু ছিটাতে চাই। তার মূল্যবোধগুলো নপুংশকবৃত্তি ছাড়া আর কী? তার সংস্কার, প্রথা, নিয়ম, সমাজ ও সামাজিক ঔচিত্যবোধ কিংবা পরস্পর সম্পর্কে দায়িত্ববোধ নিয়ে পুরুষ পুরুষত্বহীন আর নারী তার খেলনা। তথাকথিত উচ্চ হৃদয়বৃত্তিগুলো খলতা, ছলনা, বিদ্বেষ আর হিংসা ঢাকার উপায় মাত্র।
এই বসবাসের অযোগ্য সমাজে আমি সৃষ্টিছাড়ার মতো এসে পড়েছি। ঘৃণ্য মাছির মতো ভ্যানভ্যানে বিরক্তিকর, নর্দমার মতো খোলা নোংরা জীবনটাকে চোলাই করে যেটুকু আকর পাওয়া যায় তা-ই খেয়ে আমি বুঁদ হয়ে যেতে চাই। এ ব্যাপারে শুধু আমি আছি, স্রেফ আছি। ওই লম্বা লকলকে মেয়েলোকটাকে আমি চেয়েছিলাম। সে বলে সে নাকি অন্যের স্ত্রী। হ্যাঁ, আমি জানি সে একটি বীর্যহীন-আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না-চলন্ত মাটির ঢেলার স্ত্রী। ও একটা সামাজিক মানুষ, আমি জানি সবার মতো সেও একটা পুতুল। বহুদিনের তৈরি সংস্কার, প্রথা, আবেগ তাকে পুতুলের মতো নাচাচ্ছে। সে জানে না, তার কিছুই নেই-সে কিছুই নয়। সে বিশ্বাস করে মহত্ত্বে, আশায়, ক্ষমায়, প্রীতিতে, দয়ায়। ওই মেয়েটাকে আমার না হলেও চলে। কিন্তু আমি আরেকটি নির্বোধ ওথেলো সৃষ্টি করার আনন্দ পেতে চেয়েছিলাম। ওর সামনে আমি মেয়েটাকে উলঙ্গ করতে চাই এবং তা-ই করব।’
তৌফিক সত্যিই সেটি করে দেখায় এবং উপন্যাসের তুঙ্গ মুহূর্ত উপস্থিত হয়। শুরু হয় ‘সভ্য’ কথক এবং ‘বন্য’ তৌফিকের দ্বৈরথ। আর ওই নারীও যেন সেই আদিম দ্বৈরথের সাক্ষী হতে চায়, নগ্ন অবস্থায়ই, সভ্যতার উপহার পোশাক দিয়ে নিজেকে আবৃত না করেই।
আলোচনা করে উপন্যাসের কিছুই বোঝানো যায় না। তবু একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম পাঠকের সঙ্গে, কারণ এই তিন চরিত্রের কোনোটিই আমাদের চেনা নয়। আমাদের সামাজিক-স্বাভাবিক জীবনে এরকম ঘটনা ঘটে না। এই উপন্যাসে তিনটি চরিত্রেরই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই স্বাতন্ত্র্য সমস্ত নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম-কানুন, ঔচিত্যবোধ-মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে এরকম চরিত্রের অস্তিত্ব থাকা প্রায় অসম্ভব, থাকলেও কথকের মতোই তারাও সমাজ-সভ্যতা-সৌজন্য-সংষ্কারের মোড়কে নিজেদের ঢেকে রাখে।
হাসান কেন লিখেছিলেন এই উপন্যাস? ওই যে বললাম, পশ্চিমা আধুনিকতার অভিঘাত এসে পড়েছিল তার ওপর। কেন লিখেছিলেন এবং কেনই-বা অস্বীকার করেছিলেন সে প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন এভাবে : ‘আমার বয়স টেনেটুনে কোনোরকমে একুশ বছর, তখন ষোলো দিনে রচনাটি শেষ করেছিলাম। গল্প, বড় গল্প, নভেলা বা উপন্যাস কি একে বলা যেতে পারত জানি না। কোনোদিন মাথাও ঘামাইনি। সেই সদ্য গোঁফ-ওঠা বয়সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। রাজশাহীর পুরনো ভাঙা শহর আর অবিকল গ্রাম মেশানো শুকনো রুখু আবহাওয়ায় চৈত্রের ঘূর্ণি, পদ্মার উঁচু পাড়ের দু পাশে টকটকে লাল শিমুল আর শহরের ভেতরের ক্বচিৎ কৃষ্ণচূড়ার হিঙুল নকশি পর্দার উন্মোচন আর আমার অবাধ জীবনযাত্রায় সন্ধেয় কলেজে দুএকটি ক্লাস, তুমুল আড্ডা, সাড়ে আট আনায় পেটপুরে আমিষ ভোজ-জীবনের এই বাইরের আবেষ্টনীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল আমার প্রথম পড়া ‘ইন্টেমেসি’র গল্পগুলো-হেমিংওয়ের ‘দি স্নোজ অব কিলিমানজারো’, দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ উপভোগের দারুণ মোহমুগ্ধতা, হুর্শাল্-এর ‘ফেনোমেনোলজি’ আর হাইডেগারের ‘বিয়িং অ্যান্ড টাইম’ পড়ার আর না- বোঝার তীব্র উত্তেজনা। এসবেরই ফল বৃত্তায়ন।
মাথা ক্রমে ঠান্ডা হয়ে এলো। স্থির ধারণা হলো যে লেখক হিসেবে সদ্য পথ ধরেছি। ‘বৃত্তায়ন’ পরিত্যাগ করা দরকার। ব্যস, চলে গেল বইটি বিস্মৃতি আর বিরাগের তলায়।’
হ্যাঁ, পশ্চিমা আধুনিকতার বৃত্তে তিনি বন্দি হতে চাননি, সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন, হতে চেয়েছেন এ-দেশের মানুষের যূথবদ্ধ জীবনের ভাষ্যকার। তার পরবর্তীকালের সাহিত্যে আমরা তারই সার্থক রূপায়ণ দেখতে পাই।
সময়ের আলো/আরএস/