
ইরানি মানবাধিকার আন্দোলন কর্মী নার্গিস মোহাম্মদি ডিফেন্ডার্স অব দ্য হিউম্যান রাইটস সেন্টার সংস্থার উপপ্রধান। তিনি এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নার্গিস মোহাম্মদির লেখা ‘হোয়াইট টর্চার : ইন্টারভিউজ উইথ ইরানিয়ান উইমেন প্রিজনারস’ বই থেকে সময়ের আলো পত্রিকার জন্য ধারাবাহিক অনুবাদ করেছেন জায়েদ উল এহসান। আজ তার পঞ্চম পর্ব প্রকাশিত হলো-
দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে আমার নিজ সেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আমার হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রায় অচল হয়ে যাচ্ছিলাম। অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আগে জেলের প্রহরীকে জানানোই ভালো বলে মনে করলাম। জেলার এলেন এবং আমি বুঝিয়ে বললাম যে আমি বেশ অসুস্থ। তিনি ফিরে এসে বললেন, ‘গায়ে জড়িয়ে হাসপাতালে যাও।’ ৪ নম্বর ওয়ার্ডে একটি কক্ষ আছে যেখানে দুটি বিছানা, একটি ইসিজি মেশিন এবং কিছু চিকিৎসাসামগ্রী রয়েছে। কোনো বন্দি অসুস্থ বোধ করলে বা তাদের কিছু হলে সেখানে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি উঠে চাদর গায়ে দিয়ে রওনা দিলাম।
করিডোরে কয় কদম হেঁটেছি মনে নেই, তবে একটু পরেই মাটিতে শব্দ করে পড়ে গেলাম। মাথা প্রচণ্ড ঘোরাচ্ছিল, তবে আমি অজ্ঞান হইনি। সারা শরীর অবশ বোধ হচ্ছিল। জিভ, মুখ কিছুই নাড়াতে পারছিলাম না। আমার কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি যেখানে পড়ে গিয়েছিলাম সেই করিডোরে বন্দিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকে। আমাকে পড়তে দেখে কেউ একজন চিৎকার করে উঠল। যাই হোক, তিনজন লোক এসে একটি কম্বল দিয়ে জড়িয়ে আমার হাত ধরে ২০৯ নং ওয়ার্ডের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গেল।
ইসিজি নেওয়ার পর তারা আমাকে কিছু ইনজেকশন দিল। সেই রাত থেকে যখনই এই জিনিসগুলো ঘটেছে, আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হতো। আমার অবস্থা দিনে আরও খারাপ হতে থাকে। ডাক্তার আমাকে প্রতি রাতে দেওয়ার জন্য কিছু ওষুধ দিতেন। রক্ষীরা আমাকে এক গ্লাস পানির সঙ্গে ওষুধ দিত। এর পরেও বেশ কয়েকবার আমি পড়ে গিয়েছিলাম। একবার ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি আমার পড়ে যাওয়াটা রোধ করতে বা কন্ট্রোল করতে পারি কি না? আমার কাছে সেই প্রশ্নটি হাস্যকর লেগেছিল। আমি তখন আর মৃত্যুকে নিয়ে ভয় পেতাম না, ভয় হতো এই দুঃসহ কারাজীবন নিয়ে।
একবার ডাক্তারের দেওয়া ইনজেকশন প্রত্যাখ্যান করলে তারা আমাকে চেপে ধরে তা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করি। অবশেষে চিৎকার করতে থাকি। ডাক্তার তখন একজনকে বলেন শিকল নিয়ে আসতে। নিজেকে পাগলা গারদে বন্দি কোনো রোগী মনে হচ্ছিল। উল্টোদিকে পুরুষদের ওয়ার্ড থাকার কারণে আমি যতবারই চিৎকার করতাম তারা দরজা লাগিয়ে রাখত। একবার টয়লেট থেকে আসার সময় আমি নিচে পড়ে যাই। একজন ডাক্তার দৌড়ে সিরিঞ্জ নিয়ে এসে গার্ডকে বলল আমাকে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য। গার্ড বলল, ‘আপনি কোনো নার্সকে দিয়ে দেন।’ তারা একে অপরের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছিল না। এই যদি হয় অবস্থা তা হলে কারাগারে বন্দি অসুস্থ রোগীরা কীভাবে তাদের ওপর আস্থা রাখবে, বিশ্বাস করবে? একজন ডাক্তার যখন রোগীকে বলেন, মিসেস মোহাম্মদি, এখন মরে যাও। মরে গিয়ে জাহান্নামে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে শাস্তি ভোগ করার সময় চলে এসেছে-এমনটা বলে তখন আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় যে এই মানুষগুলো কী করছে। তারা মানুষের জীবন বাঁচানোর শপথ নেন, আর সরকারের নির্দেশে খুন করেন।
দিন কেটে যায়, আমি আলী এবং কিয়ানার একটি শব্দও শুনি না। তাদের দেখতে না পাওয়াটা আমাকে এতটা বিরক্ত করেছিল যে মাঝেমধ্যে আমি মরার কথা ভাবতাম। একটি সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে আমার থাকা এবং শ্বাস নেওয়া আমার খুব প্রয়োজন ছিল। কিছু জাগতিক জিনিসেরও প্রয়োজন ছিল-যেমন সূর্য দেখা, আকাশের দিকে তাকানো, বিড়াল দেখা, গাছ থেকে একটি পাতা পড়া, ভালো ঘ্রাণ পাওয়া, কোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা এমন কিছু যা জীবিত হওয়ার লক্ষণ। এটা কল্পনা করা অসম্ভব যে কীভাবে সূর্য না দেখা, আপনার ত্বকে বাতাস অনুভব না করা এবং আপনার চারপাশে অবিচ্ছিন্ন নীরবতা মানুষের লড়াই এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে নষ্ট করে দেয়। একজন আদর্শবাদী যোদ্ধা কখনো কল্পনাও করতে পারে না যে তারা যে জিনিসগুলোকে সেলের বাইরে উপভোগ করে তা থেকে বঞ্চিত হওয়া কিছু মানুষের সুখের কারণ হতে পারে।
সেলের শর্ত আর জিজ্ঞাসাবাদগুলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা আপনার ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য এবং মানসিক চাপ প্রয়োগ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটা মানুষের মনের একটা অংশে ফাটল ধরায়। আমি জেইনাব জালালিয়ান নামে একটি মেয়ের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন সেলে ছিলাম। সে ছিল কুর্দি মেয়ে। একদিন আমি ওর মাথায় দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলাম কিছু হয়েছে কি না। ও বলেছিল যে কুর্দিস্তানে বন্দি ছিল ছয় মাস। কুর্দিস্তানের সেই কক্ষে, জিজ্ঞাসাবাদকারী একবার তার মাথায় একটি ঢালাই লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করেছিল যার কারণে তার মাথার খুলিতে এই গভীর দাগ। তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং তারপর তাকে আবার সেলে রেখে যায়। সে বলেছিল যে তার সেল সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকত।
একবার সে তার দাঁত ব্রাশ করছিল এবং ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় কারারক্ষী তাকে ডেকে উঠানে নিয়ে গেল। তখন বাইরে সূর্য উঠেছে, কিন্তু সে ভেবেছিল মধ্যরাত। তার সঙ্গে দু-তিন দিনের সাহচর্য আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল। তাকে কুর্দিস্তান থেকে ২০৯ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা বারবার তাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য বলে। তাকে বলা হয়েছিল যে, সে যেন স্বীকার করে নেয় সে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সে সাক্ষাৎকার দিতে এবং মিথ্যা বলতে অস্বীকৃতি জানায়।
জেইনাবের প্রতিরোধী ইচ্ছা ও চেতনা দেখে তার শক্তি এবং মানবতাবাদী বিশ্বাসের প্রতি আমাকে অবাক করেছে। নির্জন কারাবাসের তিনটি সময়কালে, আমি এমন অনেক মহান পুরুষ এবং মহিলাদের দেখেছি যারা দৃঢ় বিশ্বাস এবং দৃঢ় সংকল্পসহকারে চাপ সহ্য করেও দাঁড়িয়েছিলেন এবং তারা তাদের বিশ্বাসের ওপর জোর দিয়েছিলেন এমনকি তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক মূল্য দিয়েও। জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, আমাকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা হয়। আমাকে সেখান থেকে ছাড়ার পরে নিরাপত্তা এজেন্টরা হাসপাতাল থেকে আমার মেডিকেল রেকর্ডগুলো নিয়ে যায়। পরে আমার জিজ্ঞাসাবাদে আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম এবং প্রশ্নকর্তা উত্তর দিয়েছিলেন-‘আমাদের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ে ডাক্তার আছেন যারা আপনার ডাক্তারদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।’
এই বাক্যটির আমার কাছে একটি বিশেষ অর্থ ছিল। তারা একজন বন্দির শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার অবনতি করেই শুধু ক্ষান্ত হন না। তারা পরবর্তী সময়ে স্বাভবিক জীবনে ফিরে আসার জন্যও বাধা হয়ে দাঁড়ান। এটা তারা ইচ্ছাকৃতই করেন। জেলের প্রধান প্রশ্নকর্তা আমার মেজাজ, আগ্রহ এবং আমাকে বিরক্ত করে এমন জিনিসগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
আমার সবসময় কিছু চিবানোর অভ্যাস, আমি যেভাবে লিখি, ইরানি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সপেকশন কোম্পানিতে বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এবং এমনকি আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্কসহ সবকিছুই তিনি জানতেন। কেন তিনি আমার আত্মার সঙ্গে এত পরিচিত ছিলেন এবং কেন তিনি এটি সম্পর্কে এত পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান রাখেন সেই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছি? তিনি রোগ, ওষুধ, চিকিৎসা, শরীর, আত্মা এবং মনের দুর্বলতাগুলো পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন বলেই এত সবকিছুর খোঁজ রাখছিলেন। আমার সঙ্গে আরও অনেক অত্যাচার করাই বাকি ছিল।
সময়ের আলো/আরএস/