উদ্বোধন অনুষ্ঠান বলতে ছিল না কিছু। গত আসরের দুই ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড ম্যাচেই ৫ অক্টোবর পর্দা উঠেছিল এবারের বিশ্বকাপের। দেখতে দেখতে শেষের দোরগোড়ায় ক্রিকেটের এই মহাযজ্ঞ। আজ ফাইনাল। লড়বে স্বাগতিক ভারত আর অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচকে ঘিরে আয়োজকরা রেখেছে বিভিন্ন আয়োজন। অর্থাৎ সমাপনী অনুষ্ঠানটা জমজমাট হবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। বোধনপর্বে কোনো আয়োজন না রেখে সমাপনীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন, বিষয়টাকে অনেকেই দেখছেন বাঁকা চোখে। তবে এটা মানতে হবে আয়োজক ভারত এবার ভিন্ন স্বাদই ক্রিকেটপ্রেমীদের দিচ্ছে উল্টো আয়োজনে!
নিন্দুকরা হয়তো ভাবছেন, বিশ্বকাপ জয়ের নীলনকশা তৈরি করেই এমন ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে ভারত। আইসিসির আসর হওয়া সত্ত্বেও পিচ ব্যবহারে স্বাগতিকদের বাড়াবাড়ি নিয়ে যে সমালোচনা চলছে, তা কিন্তু ভারতের নীল নকশারই প্রতিবাদ। তবে আয়োজক ভেদে বিশ্বকাপ আয়োজনে ভিন্নতা, এটা নতুন কিছু নয়। ক্রিকেটে বাণিজ্যের সর্বোৎকৃষ্ট বাজার হয়ে ওঠা এই উপমহাদেশ যতবারই আইসিসির এই মেগা আসরটির আয়োজনভার নিয়েছে, প্রতিবারই দিয়েছে ভিন্ন উপহার। এবার সেই ধারায় ছেদ পড়লে চলবে? এই অঞ্চলের অঘোষিত ক্রিকেট মোড়ল ভারতই বা তা হতে দেবে কেন?
১৯৮৭ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ আসর বসে উপমহাদেশে। আয়োজক ছিল ভারত আর পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বারের আয়োজনে দুই দেশের সঙ্গে ছিল শ্রীলঙ্কাও। ২০১১ সালে তো এই তালিকায় নাম উঠেছে বাংলাদেশেরও। এভাবে যৌথভাবে বিশ্বকাপের মতো মেগা আসর আয়োজনে সম্প্রীতির উৎকৃষ্ট নজিরই স্থাপন করেছে উপমহাদেশ। কিন্তু ক্রিকেট রাজনীতিতে অন্যদের থেকে কয়েক হাজার ক্রোশ এগিয়ে যাওয়া ভারত এবার হেঁটেছে উল্টো পথে, প্রথমবার একাই বিশ্বকাপ আয়োজন করল তারা। গঙ্গা-যমুনায় সম্প্রীতি ভেসে গেল, উপমহাদেশে একক আয়োজনে বিশ্বকাপ দেখল ক্রিকেট বিশ্ব।
উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের বড় ভিন্নতা বুঝি এখানেই। তাই বলে আয়োজনের মাহাত্ম্য খাটো হয়েছে, এভাবে অনুসিদ্ধান্ত। ভারতে হোক কিংবা পাকিস্তানে, শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশে-ক্রিকেট রাঙানোর এই আয়োজন তো আমাদের সবারই। ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে বিশ্বকাপের এটি ত্রয়োদশ সংস্করণ, ক্রিকেটের সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ আসরটি এই উপমহাদেশ আয়োজন করল চতুর্থবার। প্রতিবারই মিলেছে ভিন্ন কিছুর স্বাদ। প্রথম দুবার বিশ্বকাপ পেয়েছে নতুন চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের মাটিতে আয়োজিত প্রথম আসরটি ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটের পালাবদলের মঞ্চ।
১৯৭৫, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৩-ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে আয়োজিত প্রথম তিন বিশ্বকাপই ছিল ৬০ ওভারের ওয়ানডে। এখন যে সংস্করণটি ৫০ ওভারের বনে গেছে এর পেছনে কিন্তু ১৯৮৭ বিশ্বকাপের বড় ভূমিকা আছে। এই উপমহাদেশে দিনের আলোতে ম্যাচের ১২০ ওভার শেষ করা ছিল কঠিন, বিষয়টি মাথায় রেখেই ওই বিশ্বকাপের বছর দুয়েক আগ থেকেই ৬০ ওভারের ওয়ানডে বনে যায় ৫০ ওভারে! নতুন স্বাদের ওয়ানডে ম্যাচের বিশ্বকাপ সাড়া ফেলেছিল বেশ। কিন্তু নিজ আঙিনাতেই হৃদয় ভেঙেছিল উপমহাদেশের দলগুলোর। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারত এবং উদীয়মান পরাশক্তি পাকিস্তানকে কাঁদিয়ে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বনে যায় অস্ট্রেলিয়া।
১৯৯৬ সালে পরের আয়োজনটি অবশ্য উপমহাদেশকে দিয়েছিল দুহাত ভরে। ভারত আর পাকিস্তান আগে বিদায় নিলেও বিশ্বকে চমকে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় আয়োজনেও নতুন চ্যাম্পিয়ন! লাহোরের ফাইনালে অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা সেবার কাঁদিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংদের হাত ধরে সেই অস্ট্রেলিয়া এরপর হয়ে উঠল মহাপরাক্রমশালী। ১৯৯৯, ২০০৩ এবং ২০০৭-উপমহাদেশের তিন দল পাকিস্তান, ভারত এবং শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেটের বৈশ্বিক আসরে অজিরা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। তাদের ওই সোনালি যাত্রার সমাপ্তিও কিন্তু এই উপমহাদেশেই। ২০১১ সালে অজিদের আধিপত্য খর্ব করে দিয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত।
বিশ্বকাপ সেবার তার দায় শোধ করেছিল। ক্রিকেটের অহংকার শচিন টেন্ডুলকারের যে শেষ ছিল ওটাই। ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডই যিনি নিজের করে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপ জয় ছাড়া তিনি ক্রিকেট ছাড়বেন, ক্রিকেট দেবতা তাই বুঝি সে যাত্রায় আর মুখ ফেরাতে পারেননি। আসরটিতে ছিল উপমহাদেশের দলগুলোরই জয়জয়কার। টিম বাংলাদেশ প্রত্যাশা মেটাতে ব্যর্থ হলেও সেমিফাইনালে উঠেছিল ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা। পরে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে ভারত-শ্রীলঙ্কা ফাইনাল। উপমহাদেশের দুদলের ফাইনাল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখে প্রথমবার। অজি আধিপত্যের অবসান ঘটানো ২০১১ বিশ্বকাপ তাই অনেক অনেক ভিন্ন কিছুরই স্বাদ দিয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের।
এবারও ভিন্নতা কিছু কম নয়। ওয়ানডেতে এই বিশ্বকাপই তো টেনে এনেছে টি-টোয়েন্টির আমেজ। হয়েছে রানোৎসব, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি। শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান লিগপর্ব থেকে বিদায় নিলেও শ্রেয়তর দল হিসেবে ফাইনাল খেলছে ভারত। কোহলি গড়ছেন ‘বিরাট’ সব কীর্তি। ২০১১ সালে শচিনের ক্যারিয়ার পূর্ণতা পাওয়া বিশ্বকাপে যে কোহলির তারকারূপে উত্থান, তিনিই কি না এই বিশ্বকাপে ভেঙে দিয়েছেন শচিনেরই ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড। অধিনায়ক রোহিত তো ছক্কার সব রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার মঞ্চই বানিয়ে ফেলেছেন এই মেগা আসরকে। অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক-হেররিখ ক্লাসেনরাও ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠেছেন অতিমানব।
রানোৎসবের মঞ্চ হয়ে উঠা এই বিশ্বকাপটাকেই আবার দুর্দান্ত বোলিংয়ে রাঙিয়ে তুলেছেন মোহাম্মদ শামি। ক্রিকেট যে এখনও শতভাগ ব্যাটারদের খেলা বনে যায়নি, সেই স্বাদটাই দিয়েছেন ভারতীয় পেসার।
সময়ের আলো/আরএস/