ক্রিকেট ভারতীয়দের কাছে ধর্মের মতো। দেশটিতে চতুর্দশতম পূজার নাম ক্রিকেট। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের দেশ ভারত। তবে একটি জায়গায় সবাই এক। দেশটির সোয়াশ কোটি মানুষকে এক সুতোয় বেঁধেছে ক্রিকেট। দেশটির বহু সংস্কৃতির স্রোত এসে মিশেছে ক্রিকেট। বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ক্রিকেট মানেই ট্রফি উৎসবের মঞ্চ। শিরোপা জেতার আবেগকে সীমানার বাইরে রেখে মস্তিষ্ককেই প্রধান হাতিয়ার করেছে অজিরা। হৃদয়ের ভাপে-তাপে গলে না গিয়ে মাথা খাটিয়ে প্রতিপক্ষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের জুড়ি মেলা ভার। মোটকথা ক্রিকেটে পেশাদারিত্বের শেষ কথা অস্ট্রেলিয়া।
অজিরা মানসিকতায় কতটা পেশাদার সেটা অনুধাবন করতে খুব বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই বিশ্বকাপেই রবিন লিগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে জয়ের জন্য ২৯১ রানের টার্গেটের সামনে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে ছিল ৭ উইকেট হারিয়ে ৯১ রান। এখান থেকে কি জেতা সম্ভব? শেষ ৩ উইকেটে ২০১ রান তোলার প্রায় অসম্ভব এক সমীকরণ। অন্য কোনো দল হলে হারটাকেই অনিবার্য মেনে নিয়ে রণে ভঙ্গ দিত। আর এখানেই অন্যদের চেয়ে অজিরা আলাদা। অবিচ্ছিন্ন অষ্টম উইকেট জুটিতে জয় তুলে নিয়েই মাঠ ছাড়লেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও প্যাট কামিন্স। ২০১ রানে অপরাজিত ইনিংস খেললেন ম্যাক্সওয়েল। ইনজুরি, পায়ের ক্রাম্প কোনো কিছুকেই গ্রাহ্য না করে ইতিহাস জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়লেন ম্যাক্সওয়েল। তাকে টেস্ট ক্রিকেটের টপঅর্ডার ব্যাটারের মতো সুযোগ্য সঙ্গ দিলেন ৯ নম্বরে খেলতে নামা কামিন্স। প্রান্ত আগলে রেখে ৬৮ বল খেলে করলেন ১২ রান। পরিস্থিতির দাবি মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন তাই করলেন এই দুজন। ম্যাচ শেষে অজি অধিনায়ক কামিন্স বললেন, এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, যেকোনো পরিস্থিতি থেকে আমরা ম্যাচ বের করে আনতে পারি।
উপমহাদেশ তথা ভারতীয় ক্রিকেটের মূল সুর হৃদয়তাড়িত। আবেগই এখানে মুখ্য। বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের ৩৫তম জন্মদিনে ব্যাটিং বিস্ময় শচিন টেন্ডুলকারের ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড স্পর্শ করেন এ সময়ে ভারতীয় রানমেশিন বিরাট কোহলি। তার অর্জনে ভাগ বসানো কোহলিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত শচিন টুইটার বার্তায় লেখেন, ‘৪৯ থেকে ৫০-এ যেতে আমার লেগেছিল ৩৬৫ দিন। আশা করছি, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তুমি ৫০-এ পৌঁছাবে।’ ব্যাটিং মাস্টার শচিনের কথাই সত্যি হলো। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে শচিনের মাঠে শচিনের সামনেই ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ব্যাটার হিসাবে ৫০ সেঞ্চুরির মালিকানা নিজের করে নিলেন কোহলি। এই বিরল অর্জনের পর কোহলিকে ‘বিরাট’ বলে সম্বোধন করেছেন শচিন।
বুধবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেমিফাইনালে ১১৩ বলের ইনিংসে ১১৭ রানের ইনিংস খেলেন কোহলি। এর মধ্য দিয়ে শচিনের দুটো বিরল রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন কোহলি। ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির পাশাপাশি, এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের মাইলফলক পেরোলেন কোহলি। ২০০৩ সালে এক বিশ্বকাপে ১১ ইনিংসে ৬৭৩ রান সংগ্রহ করে এই রেকর্ডটি দখলে রেখেছিলেন শচিন। ১০ ইনিংসেই সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড গড়লেন কোহলি। এই বিশ্বকাপে তার সংগ্রহ ৭১১ রান।
কোহলির এই ঐতিহাসিক অর্জন নিয়ে উচ্ছ্বসিত ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন, ভারতের ড্রেসিংরুমে তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখার সময় সতীর্থরা তোমাকে মজা করে বলেছিল আমাকে প্রণাম করতে। তুমি সেই মজা না বুঝে আমাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলে। আমি হাসি থামাতে পারিনি। আজ তুমি আমার হৃদয় জিতে নিয়েছ। সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ বিরাট হয়ে গেছে। একজন ভারতীয় আমার রেকর্ড ভাঙায় আমি প্রচণ্ড খুশি। ২০১১ বিশ্বকাপ জেতার পর শচিনকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তরুণ কোহলি। আবেগঘন ভাষায় বলেছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটকে যিনি এত বছর ধরে কাঁধে করে বয়ে চলেছেন, আজকের এই দিনে তাকে কাঁধে নেব না তো কি করব? ভারতীয়দের একটি ট্রফি জয় মানে অতীত-বর্তমান গৌরব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটীয় দর্শন এককথায় জয়। শোকেসে ট্রফির সংখ্যা বাড়ানো। ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচকে সামনে রেখে অজি বোলিংয়ের অন্যতম নির্ভরতা মিচেল স্টার্ক বলেছেন, দুই দলের ক্রিকেটাররাই ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে এমন ম্যাচ আগে খেলেছে। আমি মনে করি না, দুই দলের কারও জন্যই এমন উপলক্ষ নতুন কিছু। কিন্তু ভারতের দিক থেকে বাস্তবতা ভিন্ন। ক্রিকেট মানেই ভারতীয়দের জন্য সবসময়ই নতুন কিছু। নতুন আবেগে ভেসে যাওয়া।
সময়ের আলো/আরএস/