এককথায় বলতে গেলে আমরা এখন পার করছি কঠিন সময়। নির্বাচন সন্নিকটে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে হরতাল, অবরোধ এবং সঙ্গে সহিংসতা। একই সঙ্গে প্রতিদিনের মিটিং, মিছিল এবং সমাবেশ আমাদের নিত্যকর্মের পথে নানাবিধ বাধা সৃষ্টি করছে।
অনেক কিছুর মতো এসব অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রভাব ফেলছে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে। বিঘ্নিত হচ্ছে প্রতিদিনের শ্রেণি কার্যক্রম, বিঘ্নিত হচ্ছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। এ সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের পরীক্ষা চলে কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে তা বন্ধ রাখা হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ঢুকে গেছে। বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রমও পরিচালিত হয় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কখনো কখনো দলীয় নেতৃবৃন্দের ইচ্ছাতেই চলছে শ্রেণি কার্যক্রম। তাদের ইচ্ছাতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। কখনো কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ছুটে যেতে হয় মিটিং-মিছিলে। তা না হলে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। নেতৃবৃন্দের ইচ্ছাতে মেলে হলের থাকার ছাড়পত্র, না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছাড়তে হয়। এ যেন এক অরাজকতার জগৎ।
অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর, প্রথমেই তিনি শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি শুরুতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেন। সেই সময় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দ করেন। এ কাজের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি সবার আগে জাতিকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই শিক্ষা শুধুই ডিগ্রি লাভের শিক্ষা নয়, এ শিক্ষা হবে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষা, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার শিক্ষা। তাই শুধু শিক্ষা খাতে অধিক বাজেট ছাড়া এই আকাক্সক্ষা পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে এর সঙ্গে আরও অনেক কাজও করতে হবে। শিক্ষার্থীদের গ্রন্থমুখী করতে হবে। তাদের মধ্যে পাঠের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে মানসম্মত গ্রন্থ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরেকটি স্বপ্ন ছিল নারী-পুরুষের শিক্ষায় সমতা। এ দেশে আগে থেকেই তো পুরুষের শিক্ষাব্যবস্থা চলমান ছিল, এর সঙ্গে তিনি নারী শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। তিনি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতিও মনোযোগ দিতে বলেছেন, যা উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কিন্তু এ সময়ের কঠিন পরিস্থিতি অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের গ্রন্থ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, সরিয়ে নিচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও। কোথাও কোথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে বেশ অবনতি দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক কার্যক্রমের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সুচারুভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। বিঘ্নিত হচ্ছে সব ধরনের গবেষণা কার্যক্রম। এটিকে উন্নয়নের পথে দ্বিধা বলা যেতে পারে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সবার আগে গড়ে তুলতে হবে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না করতে পারলে কখনোই এ দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমানে শুধুই রাজনৈতিক প্রভাবে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সাধারণভাবে শিক্ষার মানে দারুণ অধোগতি দেখা যাচ্ছে। এই দুর্ভাগ্য প্রথম বরণ করছে শিক্ষার্থীরা, এরপর শিক্ষার্থীর পরিবার আর শেষ পর্যন্ত সমগ্র জাতি। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক লাভের চিন্তা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব।
তা ছাড়া যদি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলি তা হলে তা শিশু শিক্ষার্থীদের বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত করেছে আর রকমারি পরীক্ষা নামের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে জীবন থেকে সব আনন্দ হরণ করেছে। আমরা নিজেরাই জানি না কী ধরনের শিক্ষা কিংবা কোন শিক্ষা শিক্ষার্থীকে দিতে চাইছি, কেমন হবে তার ভবিষ্যৎ, কী দেবে সে জাতি এবং দেশকে।
আমরা সবাই জানি, লেখাপড়া হওয়া উচিত আনন্দময় অর্থাৎ প্রীতিকর। কিন্তু শিক্ষাকে আমরা যেভাবে পরীক্ষা আর গ্রেডিংয়ের প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে, তা প্রীতিকরের বদলে ভীতিকর হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনাচার।
প্রতিদিনের অনিরাপদ পথযাত্রা যেমন কাক্সিক্ষত নয় তেমনি নিরাপত্তার খাতিরে বাড়িতে বসে অনলাইন ক্লাস যা সবসময় সফল হয়ে ওঠে না। এটি পাঠগ্রহণের চেয়ে পাঠের প্রতি বিরক্তি অর্জন করা হয় বেশি। শিক্ষাকে আনন্দময় করার জন্য সবসময় চেষ্টা করতে হবে শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে সৃজনশীলতা জাগিয়ে তোলার। তার ভেতর থেকে বের করে আনতে হবে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। অনলাইন ক্লাস এতে কতটুকু সহায়তা করছে আমরা জানি না। আদৌ করছে কি না তাও জানি না।
তা ছাড়া অনেক পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয় অনলাইন ক্লাসের জন্য ল্যাপটপ কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের যোগান দেওয়া। ফলে একশ্রেণির শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে। একই ক্লাসে শিক্ষার মান প্রায় সমান রাখা যখন জরুরি তখনই শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে বিভেদমুখী।
একই সঙ্গে বলা যায়, ধস নেমেছে কলেজ শিক্ষায়ও। শহরাঞ্চলের বাইরের কলেজগুলোর অধিকাংশে ক্লাস করার দায় শিক্ষার্থীর নেই। ক্লাস নেওয়ার দায়িত্বও নেই শিক্ষকের। শোনা যায়, অনেক জায়গায় শিক্ষকদের মধ্যে একটি রফা করা থাকে ‘সপ্তাহে দুদিন আমি আসব, দুদিন তিনি আসবেন’ ধরনের। কারণ অনেকের কর্মক্ষেত্র থেকে বাসস্থান দূরে, ফলে নিজেরাই মানিয়ে-গুছিয়ে চলেন। প্রশ্ন রইল, এটি শিক্ষার সঙ্গে মানিয়ে চলা নাকি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের সঙ্গে?
এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাবে নিজেদের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনায় না এনে অনেক কলেজেই বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স খুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে শত শত ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে। এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর স্থান ক্লাসরুমে সংকুলান হচ্ছে না তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা এবং তা প্রকটভাবে। আর রাজনীতির কুপ্রভাব তো এখানে দৃশ্যমান। এভাবে প্রতিনিয়ত শিক্ষার তরী ভাসছে আমাদের দেশের জ্ঞানের সাগরে। আদতে কী হচ্ছে তা আমরা কেউই জানি না।
কখনো কখনো স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা কোচিং এবং গাইডনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। দুইয়ের ককটেলে যা প্রস্তুত করছে তার মাধ্যমে পরীক্ষা বৈতরণী পার হয়ে শিক্ষার্থী এগিয়ে যায়।
স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষকের সীমাবদ্ধতা ও কোচিং গাইডের ককটেলে যেভাবে প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীদের পাঠাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হাড়ে মজ্জায় টের পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গোড়ায় যার গলদ সে কীভাবে দেশকে কিছু দেবে! শুধু যারা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিচর্যায় পড়াশোনা করে যেসব শিক্ষার্থীরা তারাই সফল। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়টিকে প্রায় নিঃশেষই করে দিয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে বিপন্ন করে দিচ্ছে বিশেষভাবে আলোচনায় আনলে বিষয়টি অনেকেরই মনঃপুত হবে না। তবে এর সঙ্গে যুক্ত করা যায় যে বিষয়টি তা হলো, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন মানসম্মত শিক্ষক দরকার, আবার এটাও নয় যে মানসম্মমত শিক্ষক একেবারেই নেই। মানসম্মত শিক্ষক থাকার পরও আরও কিছু সংকট রয়েছে এবং তা চাইলেই অতিক্রম করা যায়।
আবার এটাও ঠিক যে, একটি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক মানসম্মত হবে এমনটি নয়। তারপরও আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। তাই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি।
একই সঙ্গে শিক্ষকদের বিদেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষিত করে এনে তাদের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দেশের উন্নয়নে প্রয়োগ করতে হবে। একটি অনাকাক্সিক্ষত বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গিয়ে ফিরে আসেন না। তাই বলে বিষয়টি সহজেই ছেড়ে দেওয়াও যায় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে কিংবা বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রস্তুত করতে না পারলে আমাদের দেশে শুরু হওয়া উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করা কিংবা যেগুলো চলমান আছে তা ধরে রাখা বা অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই একটি জাতি কিংবা দেশের উন্নতির জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এভাবে সবদিক বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সব দুঃসময় থেকে রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান দিনগুলোতে নির্বাচনি প্রচারণা কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিদিন রাস্তায় আগুন, গাড়ি ভাঙচুর এবং লাঠিচার্জ ইত্যাদি কারণে পথে চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা খাত এবং শিক্ষার্থীদের যদি এ অবস্থা থেকে রক্ষা করা না যায় তা হলে এই শিক্ষার্থীরাই একদিন রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। এ ছাড়াও সমগ্র জাতিকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।
সময় এখনই, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার। আমরা জানি, টেকসই ও প্রকৃত উন্নয়ন কখনোই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়। এ জন্য নারী শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। তবেই বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।