
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি শক্তির তৎপরতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আগামী নির্বাচনে কী হচ্ছে, এমন আশঙ্কার মধ্যে গত ২ নভেম্বর বিশ্বের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এর কভারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে স্টোরি লেখা হয়েছে, Hard power prime minister Sheikh Hasina and the fate of democracy in Bangladesh। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক চার্লি ক্যাম্পবেল। সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন বিস্ময়কর নেতা। যিনি গত এক দশকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্রুততম বর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাপক উত্থান ঘটিয়েছেন।
২০০৯ সাল থেকে তিনি টানা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যা বিশে^র সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেকর্ড। এর আগেও তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দেশটির রাজনীতিতে একসময়ের হস্তক্ষেপকারী সামরিক শক্তি এবং ইসলামপন্থীদের মোকাবিলা করে কৃতিত্বের সঙ্গে দীর্ঘ এই সময় তিনি সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
ম্যাগাজিনটিতে শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক অর্জনের প্রশংসা করে আরও বলেছে, একসময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য রফতানির দেশে পরিণত করেছেন। দেশটির জিডিপি ২০০৬ সালের ৭১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। যা দেশটিকে ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। সামাজিক সূচকগুলোও উন্নত হয়েছে, নারী শিক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে।
ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার কিংবা ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে বেশিবার নির্বাচনে জয়ী হওয়া শেখ হাসিনা আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আবারও জয়ী হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী এ কারণে যে, আমার দেশের জনগণ আমার সঙ্গে আছে। তারা আমার প্রধান শক্তি।’
জনগণের জন্য শেখ হাসিনার সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ছয় বছর নির্বাসনে থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৮১ সালে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রকে ফিরে আনতে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদ সরকার ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচনি ফলাফল বন্ধ রেখে মিডিয়া ক্যুয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী না হলেও দেশের জনগণের অধিকার আন্দোলন চালিয়ে যান। দীর্ঘ ২১ বছর সামরিক ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনে বেশি ভোট পেয়েও আসন সংখ্যা কম পান। ক্ষমতায় না আসার কারণ হিসেবে তিনি একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, দেশের স্বার্থ বিক্রি করেননি বলে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। আমেরিকার কথায় গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়নি বলেই ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে হারানো হয়েছিল।
তারপর ২০০৭ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করে প্রহসনের নির্বাচন করতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজের আয়ত্বে আনতে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোসহ নীলনকশার নির্বাচনের পাঁয়তারা শুরু করেছিল।
তখন বিএনপি-জামায়াতের পাতানো নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে বাতিল করতে বাধ্য হয়। গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সেই অনির্বাচিত সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে ১৬ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগের দুর্বার গণআন্দোলনে ২০০৮ সালে ১১ জুন তিনি মুক্তি লাভ করেন। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘দিন বদলের সনদ’ ইশতেহার ঘোষণা করেন এবং সেই নির্বাচনে একচেটিয়া নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা একটানা দেশের নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের সেবা করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বারবার প্রমাণ করেছেন জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। তিনি তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ সংসদে সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন। শেখ হাসিনা সরকার কিংবা বিরোধী দল যেখানেই থেকেছেন, সেখান থেকেই জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। একুশ বার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি তার লক্ষ্য থেকে একটুও সরে আসেননি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমবারের মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী শিক্ষা বৃত্তি, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ বহুবিধ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি চালু করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সামাজিক কর্মসূচির আওতা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেন। বর্তমানে ২৪টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তার ১২৩টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। এ ছাড়া ১ কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ডে’র মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি জনগণকে স্বল্প মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশরত্ন শেখ হাসিনার অদম্য সাহস ও অসাধারণ নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে, যা ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের বিস্ময়। শেখ হাসিনা একজন ভিশনারি লিডার। তিনি সুনির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেশ পরিচালনা করছেন। প্রথমত, তিনি চেয়েছিলেন দেশকে ডিজিটালাইজেশন করা, যা ইতিমধ্যে শতভাগ বাস্তবায়নের পথে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন। তৃতীয়ত, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থত, ২১০০ সালের মধ্যে ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করা।
শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম করে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন গণতন্ত্রের উন্নয়নে তার কোনো বিকল্প নেই। টানা ১৫ বছর জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা চাওয়া শুধু দেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন করা। এই কাজটিকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শেখ হাসিনা। যখন কোনো সংকট তৈরি হয় সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক যা-ই হোক না কেন তিনি শক্তহাতে হাল ধরেন। যখন জনগণের মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দেখা দেয়, তখনই আলোকবর্তিকা হয়ে জনগণের মাঝে হাজির হন শেখ হাসিনা। হয়ে উঠেন মানুষের ভরসার আশ্রয়স্থল।
তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতার বাইরে জনগণের অতি আপনজন। এ জন্য তিনি যে পরিচয়ে থাকুন না কেন, তিনি কখনো স্যার কিংবা ম্যাডাম নন। সবার প্রিয় ‘আপা’ হয়ে থাকেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঙ্গে সাধারণ জনগণের আছে নিবিড় সম্পর্ক। জনগণ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, কারণ তিনি সর্বদাই জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্যই টাইম ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছেন, ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমাকে উৎখাত করা সহজ নয়। একমাত্র বিকল্প হলো আমাকে নির্মূল করা। আর আমি আমার জনগণের জন্য মরতেও প্রস্তুত আছি।
অনেকের মনেই প্রশ্ন- শেখ হাসিনা বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চোখ রাঙানিকেও কেন ভয় পান না। তার শক্তির উৎস কী? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চিত করে বলেছেন, আমার শক্তির উৎস জনগণের ভালোবাসা।
সাবেক ছাত্রনেতা সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সময়ের আলো/আরএস/