
গত এক মাসে নাটোরে ১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা হেলমেট অথবা মুখোশ পরে মাইক্রোবাসে বা মোটরসাইকেলে এসে হামলা করে চলে যায়। আক্রান্তরা সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। হামলার শিকার এমন পাঁচজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিএনপি ও যুবদলের তিনজন এবং ৭ জন জামায়াতের নেতাকর্মী সমর্থক বলে জানা গেছে। হামলার ১০টি ঘটনার মধ্যে ৬টি ঘটেছে নলডাঙ্গা উপজেলায়। বাকি তিনটি নাটোর সদর, সিংড়া ও লালপুর উপজেলার। এসব ঘটনায় হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাই হামলাগুলোতে জড়িত কারাÑসে প্রশ্নের জবাব মিলছে না। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন সরকারের ইন্ধনে এসব হামলা হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসব ঘটনায় নাটোরের নলডাঙ্গা ও রাজশাহীর বাগমারাকেন্দ্রিক সর্বহারাদের একটি দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তাদের পেছনে কারা, তা পরিষ্কার নয়। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ঠিক এভাবেই আবির্ভাব ঘটেছিল ‘হাতুড়ি বাহিনীর’। এবারও নির্বাচনের ঠিক আগে একই কায়দায় হামলা হচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন দমাতে ‘গুপ্ত হামলা’ করা হচ্ছে। স্থানীয়দের ধারণা, মুখোশধারীদের পেছনে শক্তিশালী কেউ রয়েছে, তাই শনাক্ত বা গ্রেফতার হচ্ছে না।
পুলিশ, ভুক্তভোগী নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর রাত ৮টায় নলডাঙ্গায় প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। নলডাঙ্গা জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষক ও অর্থ জোগানদাতা নাসির উদ্দিন সরকারদলীয় কর্মী ও ইসলামী বক্তা আবু নওশাদ নোমানীর মোটরসাইকেলে করে নলডাঙ্গা বাজার থেকে নিজ বাড়ি বাঁশিলায় ফিরছিলেন। তারা সোনাপাতিল-তালতলায় পৌঁছালে মুখোশধারী ছয়-সাতজন মোটরসাইকেলটির পথরোধ করে দাঁড়ায়। পরে রড দিয়ে দুজনকে বেধড়ক পিটিয়ে অচেতন করে ফেলে রেখে যায় ওই মুখোশধারীরা। পরের ঘটনাটি ঘটে ২৫ অক্টোবর রাত পৌনে ৯টার দিকে। নসরতপুর বাজার থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায় পিটিয়ে জখম করা হয় জামায়াতের কর্মী ও পল্লী চিকিৎসক আলাউদ্দিনকে। পরদিন ২৬ অক্টোবর রাতে হামলা হয় আরেক পল্লী চিকিৎসক ও নলডাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমানের ওপর। তার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় হামলাকারীরা। হামলাগুলোর ব্যাপারে নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, ‘সরকারের ইন্ধনে ‘চোরাগোপ্তা’ হামলা হচ্ছে। তাই পুলিশ কাউকে ধরছে না।’
গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাটোর সদরে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে মাওলানা সাইদুল ইসলাম নামে এক মাদরাসা শিক্ষককে পিটিয়ে জখম করে। পরে তাকে মাদরাসা থেকে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার দূরে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। সাইদুল ইসলাম মাঝদীঘা নুরানী হাফেজি মাদরাসার অধ্যক্ষ এবং চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী বলে জানা গেছে। বর্তমানে তিনি নাটোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহমেদ বলেন, ‘খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যায় ঘটনাস্থলে। জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।’
এই ঘটনাগুলো ছাড়াও গত এক মাসে নাটোরের লালপুর, নলডাঙ্গা ও সিংড়া উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা একইভাবে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কুপিয়ে জখম করে ফেলে যায়। এ ছাড়া হেলমেট ও মুখোশ পরে মোটরসাইকেলে এসে অন্তত পাঁচজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কুপিয়ে রগ কেটে দেওয়া, গুলি করা এবং হাত-পা ভেঙে সড়কে ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্ত ওই পাঁচজন পদে না থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১০টি হামলার ছয়টিই ঘটেছে নলডাঙ্গায়।
নাটোরের একাধিক সূত্র জানায়, আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (সর্বহারা) সাবেক সদস্যরা প্রকাশ্যে এসেছে। তাদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে অপরাধ করছে। পুলিশ জেনেও কিছু করছে না। কারণ স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় নেতাদের প্রশ্রয় পাচ্ছে তারা। গত ২৯ অক্টোবর সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় স্থানীয় বিএনপির নেতা সাইফুল ইসলাম আফতাব গুলিবিদ্ধ হন। গত ১২ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে নলডাঙ্গার বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি সজীব হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় মুখোশধারীরা। তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বিএনপি নেতা জানান, এ ধরনের ঘটনায় তারা আতঙ্কিত। পুলিশ এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করছে না, এমনকি মামলা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তারা।
যোগাযোগ করা হলে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ওসি আবু সাদাৎ বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে তদন্ত করছে পুলিশ।
মামলা না নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাতটি মামলা হয়েছে। তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’
সময়ের আলো/আরএস/