ই-পেপার শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একুশ শতকের শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৩, ২:৪৭ এএম  (ভিজিট : ৩৭৪৬)
মানুষ প্রায়ই তার পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগে। কারণ আগের প্রজন্মের কথার ধরন, পোশাক-আশাক ও বিনোদনের অভ্যাস- কোনো কিছুই তার পরের প্রজন্মের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। ওই অমিলটার কারণেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী প্রজন্মের গায়ে অভদ্রের তকমা লেগে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। 

একুশ শতকের এই তথাকথিত ‘অভদ্র’ প্রজন্ম আত্মীয়স্বজনের চোখে অসামাজিক, পড়শির চোখে বেখাপ্পা, শিক্ষকের চোখে অমনোযোগী। আমরা সবাই এদের বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করছি কিন্তু কেউই সমস্যার গভীরে যেতে চাচ্ছি না। এদের মনোজগতের সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রজন্মের যোজন যোজন ফারাকের কারণটা নির্ণয় করতে চাই না। জন্মের পরপরই চোখ মেলে প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসা এই প্রজন্মটাকে গবেষকরা ‘জেনারেশন জি’ নাম দিয়েছেন। প্রযুক্তি, একক পরিবার, নগরায়ণ ইত্যাদি বহু বিষয় এই জেনারেশন জিকে প্রভাবিত করছে। 

এসব পারিপার্শ্বিকতার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে তাদের শিক্ষাজীবনে। তাদের শেখার পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আমরা যারা শিক্ষক ও অভিভাবক, তারা খুব ভাবনায় পড়ে যাচ্ছি। এখন তা হলে আমাদের করণীয় কী? ওদের এই অনিবার্য বদলকে অস্বীকার করা? জোর করে ওদেরকে আগের প্রজন্মের মতো করে ভাবতে বাধ্য করা, নাকি ওদের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য নিজেদের বদলে ফেলা? 

সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আমাদের এই জেনারেশন জির মনোজগৎটা বুঝতে হবে। এদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ যেমন আগের প্রজন্মের চেয়ে ভিন্ন, ঠিক তেমনি চিন্তাপদ্ধতি, প্রতিক্রিয়া এবং আচরণও ভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্লাসরুমে বসে একটা মানুষ ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত তার মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। এর পর থেকে তার মনোযোগ প্রতি ১-২ মিনিট পরপর সরে যেতে থাকে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো- এই মনোযোগটা নানা স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা এবং ধরে রাখা। দুঃখের বিষয় হলো, জেনারেশন জির মনোযোগ আগের যেকোনো জেনারেশনের চেয়ে কমে গেছে। ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি শহরের কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা বলার পরে তাদের মনোযোগ কমে যাওয়ার একটা অদ্ভুত কারণ জানা গেছে। এই জেনারেশনটা ফেসবুকের চেয়ে টিকটকে বেশি সক্রিয়। কারণ ফেসবুক নিউজ ফিড অনেক সময় আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বিভিন্ন আপডেটে ভর্তি থাকে। 

এসব লম্বা পোস্ট বা আপডেটের চেয়ে ১৫ সেকেন্ড বা ৩০ সেকেন্ডের রিল বেশি মজার। ১৫ সেকেন্ডের রিলের জগতে ডুবে থাকতে থাকতে এদের মনোযোগ ১৫-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তাসনিয়া নামে এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাদের এখন মোবাইলে ২-২.৫ ঘণ্টার মুভি দেখার এত ধৈর্য নেই। আমরা বিভিন্ন রিভিউ বা এক্সপ্লেনেশন ভিডিও দেখে মুভির কাহিনিটা জেনে নিই।’ আবার সাদিয়া নামে এক শিক্ষার্থী বলে, ‘নেটফ্লিক্সের লম্বা লম্বা মুভিও আমরা ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে টেনে টেনে দেখে ফেলি। পুরো দেখার এত এনার্জি নেই।’

শিক্ষক ও অভিভাবকদের কপালে ভাঁজ এনে দেওয়ার জন্য এই মন্তব্যগুলো যথেষ্ট। যেগুলো বিনোদনের মাধ্যম বলে পরিচিত, সেগুলোতেও তারা আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। তা হলে ক্লাসরুমে আমরা কীভাবে এদের মনোযোগ ধরে রাখব? আমরা যদি সেই পুরোনো ট্র্যাডিশনাল লেকচার মেথডে ক্লাস নিই, তা হলে কি এরা আদৌ মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনবে নাকি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য কিছু ভাবতে থাকবে? তা হলে কি বেশি বেশি বাড়ির কাজ দিয়ে মুখস্থ করাব? কিন্তু মুখস্থবিদ্যা দিয়ে এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সে কতটুকু এগোতে পারবে। আবার যেসব বিষয় গুগল করলেই জানা যায়, সেসব বিষয় সে মুখস্থ করবেই বা কেন। তা হলে এর সমাধান কী? 

এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বেশ কিছু ফলপ্রসূ সমাধানও উঠে এসেছে। যেমন- ক্লাসরুমে যদি একটু পরপর শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি দিয়ে ব্যস্ত রাখা যায়, তা হলে সে হাতে-কলমে বিষয়টা শিখতে পারে। 

অ্যাক্টিভিটির ভিন্নতার কারণে তার শেখাটা আনন্দময় হয়, যা শিখেছে তা সে মনে রাখতে পারে এবং এর প্রায়োগিক মূল্যটা বুঝতে পারে। তাই, দলীয় কাজ, একক কাজ, আলোচনা, উপস্থাপনা ইত্যাদি নানা কাজ দিয়ে তাদের ক্লাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্ম করতে হবে। কারণ শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কেবলই তথ্যদাতা আর তথ্যগ্রহীতার নয়। তাই, শিক্ষককে একইসঙ্গে টিচার ও ফ্যাসিলিটেটর হয়ে উঠতে হবে। 

আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা এখনও গুরু-শিষ্যের সেই ধারা বয়ে চলেছি। সেই ধারাতে শিষ্য গুরুর প্রতিটি কথা বেদবাক্যের মতো মেনে চলবে, গুরুকে ভয় করবে- একটা প্রশ্নহীন আনুগত্য বজায় রেখে চলবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্বে ক্লাসরুম ছাড়াও আরও অনেক মাধ্যম আছে। ইউটিউবে হাজার হাজার ভিডিও আছে যেখানে আমার পড়ানো বিষয়টি আরও নানাভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তা হলে, সেসব ভিডিও ইন্টারনেটে থাকার পরেও শিক্ষার্থী ক্লাসরুম পর্যন্ত কেন আসবে? সে ক্লাসরুমে আসবে সরাসরি হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। সরাসরি নিজের সমস্যার কথা শিক্ষককে জানানোর জন্য। তাই, আমি যদি আমার ক্লাসটাকে সনাতন পদ্ধতির একপেশে বক্তৃতার মঞ্চ বানিয়ে ফেলি, তা হলে সেটা মোটেও একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী হবে না। 

কিন্তু বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার কারণে শিক্ষককে অনেক রকম সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের যেসব পাঠদান কৌশল শেখানো হয়, সেগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় করানো সম্ভব হয় না। বিপুল জনসংখ্যার কারণে আমাদের এক একটা ক্লাসরুমের সাইজ হয় অনেক বড়। ১৫০ জন শিক্ষার্থীর একটা ক্লাসরুমে লম্বা লম্বা বেঞ্চের ওপর বসে থাকা শিক্ষার্থীর সামনে বক্তৃতা ছাড়া শিক্ষকের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। এখনও প্রযুক্তির সঙ্গে, মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে অনেক শিক্ষকই স্বচ্ছন্দ নন। তাই, দ্রুত সিলেবাস শেষ করতে লেকচার মেথডের বিকল্প অনেক সময়ই প্রয়োগ করার সুযোগ হচ্ছে না। অভিভাবকদের মনোজগতেও বিরাট সংকট চলছে। তারা নিজেরা পেশাগত বিভিন্ন দায়িত্বপালনে ব্যস্ত থাকছেন। সন্তান ব্যস্ত থাকছে সিলেবাস, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে খুব অল্প বয়সেই ভিডিও কনটেন্ট বানাতে শুরু করছে। ফলে সেই সন্তান মা-বাবার চেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে পারিবারিক মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। 

একই বাড়িতে বাস করেও মা-বাবা আর সন্তানের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নিজেরা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে না পেরে বিত্তশালী মা-বাবা বিভিন্ন গেজেট কিনে দিয়ে সন্তানকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। কম বিত্তশালীরাও হাজার কষ্ট হলেও সন্তানকে তাদের সাধ্যে মধ্যে সেরা ডিভাইসটা কিনে দেন যাতে সন্তান হীনম্মন্যতায় না ভোগে। এরকম ডিভাইসনির্ভর জগতে থাকতে থাকতে বাস্তব মানুষের সঙ্গে সন্তানের যোগাযোগ আরও কমে যেতে থাকে। খুব অল্প বয়সেই অনেক ছেলেমেয়ে মানসিক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে শুরু করে। আর মা-বাবা নিজেদের শৈশবের আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে সন্তানের শৈশবকে বোঝার চেষ্টা করেন। ফলাফল অনিবার্য ব্যর্থতা। 

সফল ধনকুবেরদের বানিয়ে দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির জগতে আমরা ডুবে আছি, তারা নিজেরা কিন্তু নিজেদের পণ্য নিয়ে আমাদের মতো এতটা আসক্ত নন। স্টিভ জবস তার ছেলেমেয়ের প্রযুক্তি আসক্তিকে খুব দৃঢ় হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার বানানো আইপ্যাডের জনপ্রিয়তা যখন আকাশচুম্বী, তখনও তার ছেলেমেয়েরা সেটা ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি। তারা দিনে কতটুকু প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তার একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল।

তা হলে, অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের এই দূরত্ব অতিক্রমের কি কোনোই উপায় নেই? অবশ্যই আছে। সফল ধনকুবেরদের বানিয়ে দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির জগতে আমরা ডুবে আছি, তারা নিজেরা কিন্তু নিজেদের পণ্য নিয়ে আমাদের মতো এতটা আসক্ত নন। স্টিব জবস তার ছেলেমেয়ের প্রযুক্তি আসক্তিকে খুব দৃঢ় হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার বানানো আইপ্যাডের জনপ্রিয়তা যখন আকাশচুম্বী, তখনও তার ছেলেমেয়েরা সেটা ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি। তারা দিনে কতটুকু প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তার একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। 

বেশিরভাগ টেক জায়ান্ট নিজেরা নিয়মিত বই পড়েন, বইয়ের রিভিউ লেখেন, বইসংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেন। সন্তানরা কে কী বই পড়ছে, সে সংক্রান্ত খোঁজখবর রাখেন। ঠিক একইভাবে আমরা যারা বাংলাদেশের অভিভাবক ও শিক্ষক তাদেরও সন্তানের অনলাইন ও অফলাইন গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সন্তানকে এবং শিক্ষার্থকে বুঝতে হলে আমাদেরও বিভিন্ন ডিভাইস ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ওরা যে ওয়েবসাইটগুলোতে ঢুকছে, সেগুলোতে প্যারেন্টাল রেস্ট্রিকশন ব্যবহার করতে হবে। ফেসবুক, গুগল, ইয়াহু, অ্যাপল- এরা সবাই প্যারেন্টাল রেস্ট্রিকশনের ব্যবস্থা রেখেছে। এর ফলে মা-বাবা তাদের সন্তানদের অনলাইন গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারবেন। 

আমাদের সংস্কৃতিতে মা-বাবা কিংবা শিক্ষক এখনও সন্তান বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো করে মিশতে স্বচ্ছন্দ নন। পুরোপুরি বন্ধুত্ব সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু বন্ধুসুলভ হওয়া অবশ্যই সম্ভব। যেকোনো সমস্যায় পড়লে ছেলেমেয়ের মাথায় যেন প্রথমেই তাদের মা-বাবা বা শিক্ষকের কথা আসে, তাদের সঙ্গে এটুকু বন্ধুত্বসুলভ আমাদের হতেই হবে। আমরা এই যুগে তাদের কোনোভাবেই প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারব না। 

বাড়িতে এবং ক্লাসরুমে প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করবেই। যদি প্রকাশ্যে না করে, তা হলে লুকিয়ে করবে। সে ক্ষেত্রে ওদের ডিভাইসগুলোকে শেখার কাজে ব্যবহার করতে হবে। ওদের জীবনে অনলাইন এবং অফলাইন বিভিন্ন কার্যক্রমের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। সেটা ক্লাসরুমেও করতে হবে। বাড়িতেও করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর এই সন্তানরা যেন একইসঙ্গে প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং মানবিক গুণাবলিস্বপন্ন হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। তাই, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সচেতন হতে হবে। তা হলেই কেবল একটা মানবিক, সফল, সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক ও শিক্ষক

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close