প্রতি বর্ষাতেই ব্যাঙের ছাতা জন্মায় প্রতিভাদের উঠোনে। বৃষ্টি-বাদলা শেষ হলে মাটি যখন শুকোতে থাকে তখনই মাটি ফুঁড়ে বের হয় এরা। তখন প্রতিদিনই সকাল-বিকাল ছাতার নিচে ব্যাঙ খুঁজতে যায় সে। কিন্তু আজ অবধি একটা ব্যাঙও চোখে পড়েনি। তবে তাতে ব্যাঙের ছাতার ব্যাঙ খোঁজা বন্ধ হয়নি প্রতিভার।
এবার আবার প্রতিভার সাথি হয়েছে শিশির ভাইয়ার দুই বছরের মেয়ে অবনী। গুটিগুটি পায়ে হাঁটা আর আধো আধো কথা বলা অবনী সারা দিনই থাকে প্রতিভার সঙ্গে। বাগানের ফুল-ফল, গাছের পাতা যা-ই পায়, ছিঁড়ে নিয়েই ডেকে ওঠে ‘এই পুতা’। প্রতিভাকে সে পুতা বলে ডাকে।
সেদিন সকালে উঠোনের পশ্চিম-উত্তর কোণের ঝোপঝাড়ের দিকে হঠাৎ চোখ গেল প্রতিভার। সেখানে কয়েকটি পুরোনো ছাতার পাশে বেশ বড় একটা ব্যাঙের ছাতা! এত বড় ব্যাঙের ছাতা কখনো দেখেনি সে। বাবাকে ডেকে দেখালে তিনিও আশ্চর্যই হলেন। এত বড় ব্যাঙের ছাতা নাকি তারও অদেখা। বললেন, কেউ যেন সুন্দর ব্যাঙের ছাতাটা না ভাঙে।
বিকালে স্কুল থেকে ফিরে আবার ব্যাঙের ছাতাটা দেখতে গেল প্রতিভা। তখন মনে হলো ছাতাটা যেন আরও বড় দেখাচ্ছে। ভালো করে দেখতে কাছে যেতেই কী যেন একটা দৌড়ে পালাল সেখান থেকে। তবে কি ব্যাঙ বসেছিল ছাতার নিচে?
পরদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে অবনীকে কোলে নিয়ে ব্যাঙের ছাতাটার কাছে আবার গেল প্রতিভা। তারপর যা দেখল সেখানে তা অবিশ্বাস্য!
ব্যাঙের ছাতাটার নিচে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা অদ্ভুত প্রাণী। সেটা নয় ব্যাঙ, নয় ইঁদুর বা অন্যকিছু! এবার দৌড়ে পালাল না সেটি। বরং মানুষের মতো দুই হাত জোড় সে প্রতিভাকে কী যেন বলতে লাগল কিচিরমিচির করে।
এই দেখে অবনী কোল থেকে নামার জন্য ছটফট শুরু করেছে ততক্ষণে। সাহস করে প্রতিভা বসে পড়ল ছোট্ট প্রাণীটার কাছে। ভয় পেলেও শুনতে চেষ্টা করল তার কিচিরমিচির ভাষা। কয়েক মুহূর্ত পরই বোঝা গেল খুব ক্ষীণস্বরে কিচিরমিচির শব্দের বাংলা ভাষার কথাগুলো।
অদ্ভুত প্রাণীটি বলল, অনেক দূরের এক গ্রহে বাড়ি তার। তার নাম উরম। বন্ধুদের সঙ্গে মহাকাশে বেড়াতে এসে হারিয়ে যায় সে। তারপর কয়েকজন দুষ্টুলোক তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তাদের স্পেসশিপে তুলে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। প্রতিভাদের বাড়ির পেছনের বড় জঙ্গলটায় লুকিয়ে রেখে তারা নাকি মেলা টাকা মুক্তিপণ চায় তার মা-বাবার কাছে। তবে ছোট হলেও সে নাকি অনেক কিছু বোঝে। সুযোগমতো পালিয়েছে তাদের ডেরা থেকে। বেশ সাহসীর মতোই বলল সে।
প্রতিভা জানতে চাইল, এই বাড়িতে কী করে এলো সে?
এলিয়েন ছানা উরম বলল, গত রাতে এই বাড়ির একটা বেড়াল জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিল। তখন সে তার পিঠে চড়ে চুপি চুপি পালিয়ে এখানে আসে। তারপর দেয়ালের আড়ালে ব্যাঙের ছাতার মেলায় সেও একটা ছাতা বানিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ব্যাঙের মতো ছোট বলে এই বাড়ির কুকুরটার ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে।
ততোক্ষণে ভয় কেটে গেছে। অবনীও লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে একবার প্রতিভাকে আরেকবার উরমের দিকে তাকাচ্ছে। অদ্ভুত ক্ষুদ্র প্রাণীটি তখন আরও কাছে এগিয়ে আসে প্রতিভার।
উরমের সব কথা শুনে প্রতিভা বলল, তোমার বাবা-মা এখন কেমনে খুঁজে পাবে তোমাকে?
এলিয়েন ছানা উরম বলল, আর ভয় নেই। দুষ্টুলোকেরা টাকা আনতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে আটক হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অবস্থান জেনে নিয়ে আজ ভোরে মনোফোনে কথা বলেছে বাবা-মা। তারা রাতেই এসে নিয়ে যাবে আমাকে। প্রতিভাদের বাড়ি আর ব্যাঙের ছাতার কথা কখনো ভুলবে না সে। প্রতিভাদের সে বন্ধু মেনেছে।
এ কথায় খুব মন খারাপ হলো প্রতিভার। আবার ভাবল, মা-বাবার কাছেই তো ফিরে যাচ্ছে সে। নিরাপদ ভেবে তাদের বাড়িতে একটা এলিয়েনের বাচ্চা আশ্রয় নিয়েছে, এই ভেবেও ভালো লাগছে।
উরমকে বিদায় দেওয়ার জন্য অনেক রাত অবধি জেগে থাকল প্রতিভা। কিন্তু একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই সে ছুটে গেল উঠোনের ব্যাঙের ছাতার কাছে। দেখল, কিছুই নেই সেখানে। দেয়ালের কাছের ঝোপঝাড় আর পুরোনো ব্যাঙের ছাতাগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কেবল। আর উরমের বড় ব্যাঙের ছাতাটা যেন উপড়ে তুলে নিয়েছে কেউ।
শেষ দেখাটাও হলো না বন্ধুর সঙ্গে। কিছু বলেও গেল না বন্ধু এলিয়েন ছানাটি! বুক ফেটে কান্না এলো তার। উরমকে বন্ধু হিসেবে মেনে নেওয়ার কথাটি বলা হয়নি যে।
কান্না আটকে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরতে গিয়েই আরেক বিস্ময়!
বাগানের কাছে বাইরের বারান্দার সিঁড়িতে দারুণ দুটো পুতুল বসে আছে। তারা হাসছে যেন তাকে দেখে।
এমন পুতুল কখনো দেখেনি সে। একটা বড়, একটা ছোট। তবে কি প্রতিভার জন্য বড়টা আর অবনীর জন্য ছোট পুতুলটা রেখে গেছে এলিয়েন বন্ধু উরম?
সময়ের আলো/আরএস/