দফায় দফায় ডাকা এ হরতাল-অবরোধে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। এমন একটি সময়ে এ রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হলো যখন সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকে। তার ওপরে এ রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যদিও তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই তারা অবরোধ দিয়ে আসছিল। দফায় দফায় ডাকা এ হরতাল-অবরোধে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। এমন একটি সময়ে এ রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হলো যখন সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকে। তার ওপরে এ রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জরুরি সেবা খাতের মতো শিক্ষাকেও হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখার ব্যাপারে মত দিয়েছেন অনেক শিক্ষাবিদ। কিন্তু তাতেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানসিক স্বস্তি ফিরে পাবে বলে মনে হয় না। দেশে যখন হরতাল-অবরোধ চলে তখন সবাই একধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো-চলমান হরতাল-অবরোধে অতর্কিতভাবে গণপরিবহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
দুষ্কৃতকারীদের এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে সংঘটিত হতে পারে। এ আশঙ্কা মাথায়
নিয়ে কীভাবে একজন অভিভাবক তার সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবে?
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। বিকল্প উপায় হিসেবে এটা করা হলেও বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। বছর শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাতে সময় এখন এতটাই কম যে, হরতাল-অবরোধের কারণে যদি একটি কর্মদিবসও নষ্ট হয় সেটাও পূরণ করা সম্ভব হবে না। অন্যান্য বছর ডিসেম্বর মাসে স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী নভেম্বর মাসে স্কুলের সব পরীক্ষা শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আবার এ সময়ের মধ্যেই শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বিস্তরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কিছু প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।
কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের একাংশ এই শিক্ষাক্রমকে ভালো মনে করছেন না। এমতাবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন করতে হলে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষকদের জ্ঞান ও দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। এ সময় হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের স্থবিরতার সৃষ্টি হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হোক-এটা কারও কাম্য হতে পারে না।
একসময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাপ্তাহিক ছুটি ছিল এক দিন। এখন সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছে। ফলে কর্মদিবস কমে গেছে। গত জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর এ বিষয়ে শিক্ষকদের ধারণা দেওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি কিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। স্থানীয়ভাবে এসব প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হলেও সে সময় ক্লাস কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে ক্লাস কার্যক্রম শুরু করতে শিক্ষাবর্ষের প্রায় অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বুঝে উঠতে শিক্ষার্থীদেরও সময় লেগেছে। তারপরও যেসব শিক্ষার্থী সবকিছু সঠিকভাবে বুঝে নিতে পেরেছে-এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বরং এটা বলা যায়, এখনও অনেক শিক্ষার্থী, এমনকি অনেক শিক্ষকও নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেনি। এই বাস্তবতায় সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই পরীক্ষা কার্যক্রমকে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখা যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা পরীক্ষার বিষয়ে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না।
গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবরে তারা সবসময় আতঙ্কিত থাকছে। স্কুল পর্যায়ের এ শিক্ষার্থীরা কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। অথচ এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় এরাই অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এ হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ক্লাসে উপস্থিতির হার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। গড়ে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে বলে জানা যাচ্ছে। কাম্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উপস্থিত না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসটি পুনরায় নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য আরও একটি কর্মঘণ্টারও প্রয়োজন হয়। কর্মঘণ্টা বেড়ে গেলে নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না। ফলে সেশনজট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেবে। চলমান হরতাল-অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট সৃষ্টি হবে। এমন একসময় ছিল যখন সেশনজটের কারণে একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে মূল্যবান সময় ঝরে যেত।
বর্তমানে বিভিন্ন কৌশল ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেশনজট কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার সেশনজটের কবলে পড়ে যাবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সে ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হলে তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত হলে শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের মানসিক সংকটে পড়ে যায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। বৈশি^ক মহামারি করোনার অভিঘাতে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সে সময় অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অনলাইন ক্লাস খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। চলমান হরতাল-অবরোধেও কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সে ধরনের উদ্যোগ নিতে পারবে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের কোনো হাত থাকে না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ দূর করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকা-দুটোই চরমপন্থা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের সদিচ্ছা নিয়ে নিঃশর্তভাবে সংলাপে বসলে সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জন্য
রাজনীতি করে, দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি দেশ ও
সমাজ নির্মাণ করতে রাজনীতি করে। তা হলে কেন এ ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি?
বিরোধীদলগুলোর এখন নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। নতুন চিন্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও নতুনত্ব আনতে হবে। হরতাল-অবরোধ এখন বাংলাদেশে অচল ও অকার্যকর কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এ ধরনের নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চায় না। নতুন প্রজন্মকে এখন এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জনকল্যাণে কী কী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে-সেগুলোর প্রচার করাই এখন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এবার স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
একচল্লিশ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ভিশন আছে দলটির। কিন্তু বিএনপি সেরকম কোনো ভিশন নিয়ে মাঠে নামেনি। হরতাল-অবরোধে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্ট স্থবিরতার কথা বলতে গিয়ে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মপন্থা বিষয়ে বলাটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণু আচরণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যখন স্থবিরতার সৃষ্টি হয় তখন রাজনৈতিক দলের এহেন দায়িত্বজ্ঞাহীন আচরণের কথা না বলে উপায় থাকে না।
জ্ঞানভিত্তিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের এমন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা উচিব নয়, যার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলমান হরতাল-অবরোধ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। শিক্ষার্থীরা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর উচিত হবে অকার্যকর ও অগ্রহণযোগ্য হরতাল-অবরোধের পরিবর্তে এমন কোনো বিকল্প কর্মসূচির কথা ভাবা, যার প্রভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সময়ের আলো/আরএস/