কসাই শব্দটির সঙ্গে কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক রয়েছে। তাই একটু কঠিন হৃদয়ের মানুষকে অনেক সময় কসাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে ‘বলা হয়, আপনার মনটা কসাইয়ের চেয়েও কঠোর।’ অথচ এই উচ্চ মূল্যের বাজারে কসাইয়ের কঠোর মনও গলে গেল। অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ায় বেশ কয়েকজন কসাই সিদ্ধান্ত নেন-কম দামে গরুর মাংস বিক্রির। যাতে সাধারণ মানুষ কম টাকায় গরুর মাংস কিনতে পারে।
রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার মাংস বিক্রেতারা কম দামে মাংস বিক্রির এ উদ্যোগ নেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলেই নিত্যপণ্যের দাম কমানো যায়। মাংস বিক্রেতাদের এ উদ্যোগের পর প্রশ্ন উঠেছে, মাংসের দাম কমানো গেলে অন্য পণ্যের দাম কেন নয়। কসাইয়ের মন গললেও কেন গলছে না অন্য ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের। মাংসের মতো এখন অন্যান্য পণ্যেরও দাম কমানো সম্ভব এবং দ্রুত কমানো দরকার বলেও মত দেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বাজারের তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, মাংসের মতো অন্যান্য ভোগ্যপণ্যেরও দাম কমানো সম্ভব। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজ, আলু, চিনি, চাল, আটা-ময়দা, ডাল-তেল থেকে শুরু করে মাছ-মুরগি ও ডিমের দামও আরও কমানো সম্ভব। কারণ এসব পণ্যের দাম বিশ^ বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে যতটা না বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে। তা ছাড়া দেশের বাজারে ওইসব পণ্যমূল্য বাড়ানোর সময় বিশ্ববাজারে যতটুকু বেড়েছিল এখন তার চেয়ে কমে গেছে। তাই মাংস ব্যবসায়ীদের মতো অতি লোভের মনোভাব ত্যাগ করে এবং ভোক্তার জন্য মনটা একটু নরম করলেই অন্যান্য পণ্যেরও দাম কমানো সম্ভব।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ক্যাবের পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, বিগত দেড়-দুই বছরে দেশের বাজারে যে হারে পণ্যমূল্য বেড়েছে, এখন সে দামের চেয়ে কমিয়ে পণ্য বিক্রি করা যায়। কারণ আমদানিকৃত পণ্যগুলোর দাম বিশ্ববাজারে কমে আবার আগের কম দামে চলে এসেছে। এ ক্ষেত্রে আমি উদাহরণ হিসেবে গমের কথা বলতে পারি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেড় বছর আগে গমের দাম প্রতি টন ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন সে দাম নেমে ৩০০ ডলারে চলে এসেছে। অথচ বিশ্ববাজারে গমের দাম বৃদ্ধির কথা বলে দেশে একলাফে ৩৫ টাকার আটার কেজি হয়ে যায় ৬০-৬৫ টাকা, আর ৪৫ টাকার
ময়দার কেজি হয়ে যায় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। বিশ্ববাজারে দাম কমে গেছে, কিন্তু দেশের বাজারে কি আটা-ময়দার দাম কমেছে? কমেনি। তা হলে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা এখন কম দামে গম আমদানি করে বেশি দামে আটা-ময়দা বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা করছে। সুতরাং এখন সময়ের দাবি, আটা-ময়দাসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য কমানো। আর ইচ্ছে করলেই যে পণ্যমূল্য কমানো যায় সেটি মাংস বিক্রেতারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
ক্যাবের সভাপতির গম ও আটা-ময়দার দাম কমানোর দাবির সত্যতা মেলে বাজারে। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যই বলছে, বাজারে এখন আটার গড় মূল্য প্রতি কেজি খোলা আটা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা আর প্যাকেট আটার কেজি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা, আর খোলা ময়দার কেজি ৬৫ থেকে ৭০ এবং প্যাকেট ময়দার কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। অথচ বিশ^বাজারে এখন গমের মূল্য প্রতি টনে ২০০ ডলার কমে ৩০০ থেকে ৩২০ ডলারে ঠেকেছে। সে হিসাবে দেশের বাজারে এখন প্রতি কেজি আটা-ময়দাতে ১০ থেকে ১৫ টাকা দাম কমানো সম্ভব।
একইভাবে মাসছয়েক আগেও দেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। কয়েক ধাপে দাম বাড়তে বাড়তে এখন দেশি পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা এবং ভাতীয় পেঁয়াজের কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। অথচ সম্প্রতি ভারতে পেঁয়াজের দাম কমেছে এবং ভারত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন পেঁয়াজও আসছে। তা ছাড়া দেশের বাজারেও নতুন পেঁয়াজ ইতিমধ্যে উঠে গেছে। তাই এখন অনায়াসেই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা কমানো সম্ভব বলে মত বাজার বিশ্লেষকদের।
দেশের ইতিহাসে এবার আলু নিয়ে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে, তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ২০-২২ টাকা কেজির আলু হঠাৎ করেই বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি হয়ে যায়। এখনও বাজারে ১ কেজি আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অথচ দেশে চাহিদার চেয়েও পর্যাপ্ত আলু রয়েছে। শুধু হিমাগারের মালিকদের সিন্ডিকেট এবং পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভে আলুর দাম বেড়েছে এবং একই কারণে এখনও দাম কমছে না। অথচ দেশের বাজারে আলুর কোনো কমতি নেই, আবার নতুন আলুও বাজারে চলে এসেছে। তাই এখন অনায়াসেই আলুর দাম কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব বলে মত বিশ্লেষকদের।
চিনির বাজারও এখনও বেসামাল। প্রতি কেজি চিনির দাম ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। অবশ্য বিশ্ববাজারে চিনির দাম এখনও চড়া। তবে বিশ্ববাজারে যে হারে চিনির দাম বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে দেশের বাজারে। তাই দেশের বাজারে এখন চিনির দাম কেজিতে ১০ টাকা কমানো সম্ভব বলে জানাচ্ছেন খোদ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
এই কয়েকটি পণ্যের বাইরেও সম্প্রতি প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা। চালের এই দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মত বাজার বিশ্লেষকদের। কারণ বাজারগুলোতে এখন চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে এবং ইতিমধ্যেই নতুন আমন ধান উঠেছে। তাই চালের দাম যে ৪-৫ টাকা বেড়েছে সেটিই কমানো সম্ভব এখন।
এদিকে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মধ্যে বিগত কিছু দিন সব ধরনের সবজির দাম কমেছে। কারণ বাজারে এখন শীতকালীন সবজি উঠেছে ভরপুর। তবুও যে হারে কমার কথা, এখনও সে হারে কমেনি।
পথ দেখালেন মাংস ব্যবসায়ীরা : ইচ্ছে থাকলে যে পণ্যমূল্য কমানো যায় সে পথ দেখালেন মাংস বিক্রেতারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে এই পথ দেখান মূলত বগুড়ার কালু কসাই। চলতি বছর রোজার আগে বগুড়ার গাবতলীর কালু কসাই নামের এই বিক্রেতা প্রথম ৫৮০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করে আলোচনায় আসেন। সে সময় এই দামে তার মাংস বিক্রির ভিডিও আলোচনায় আসে। কয়েক মাস পর তার মতোই উদ্যোগ নেন রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরের কসাই খলিলুর রহমান। গত সপ্তাহ থেকে টানা ৮ দিন তিনি তার দোকানে ব্যানার টাঙিয়ে ৫৯৫ টাকা কেজিতে মাংস বিক্রি করেন। তার এই মাংস বিক্রির ভিডিও ভাইরাল হলে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার এ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন হলে তার দেখাদেখি, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে, পুরান ঢাকার লালবাগসহ কয়েকটি এলাকায় এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় ৫৯০ থেকে ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করতে দেখা যায়। তাদের কম দামে মাংস বিক্রির প্রভাবে সারা দেশেই এখন মাংসের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমেছে। যদিও কিছু কিছু বাজারে এখনও ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস।
কী বলছেন খলিল কসাই : গতকাল কথা হয় শাহজাহানপুরের খলিল মাংস বিতানের মালিক ও কসাই খলিলুর রহমানের সঙ্গে। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, কুরবানির পর থেকে মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল দাম বেশি হওয়ার কারণে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করব। এতে আমাদের বিক্রিও বেড়েছে, আবার কম দামে মানুষও গরুর মাংস খেতে পারছে। এটাই আমার ভালো লাগছে। দাম বেশি হওয়ায় আমাদের মাংস বিক্রি একেবারে কমে গিয়েছিল। তাই দাম কমিয়েছি। এখন গরুর মাংসের দামও কিছুটা কমে পাচ্ছি। কম দামে বিক্রি করায় এখন লাভ কিছুটা কমেছে, কিন্তু আমার ভালো লাগছে সাধারণ মানুষ কম দামে মাংস কিনতে পারছে, যারা গত ছয় মাসেও একদিন গরুর মাংস কিনে খেতে পারেনি।
খলিলের পাশের মাংসের দোকান খোরশেদ গোশত বিতানের বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পাশের দোকানদার ও আশপাশে কয়েকটি দোকানে ৫৯৫-৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন। এতে সব কাস্টমার সে দোকানে চলে যাচ্ছে, আমাদের দোকানে আসছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও ৬০০ টাকা কেজিতে মাংস বিক্রি করছি।’
খলিলের মাংসের দোকানে মাংস কিনতে আসা ক্রেতা আনিসুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর কারণে আমি এখানে এসেছি। অনেক ক্রেতা আসছে, আমিও এসেছি। বাজারে অনেক দাম বেশি। এ কারণেই খলিল গোশত বিতানে মাংস নিতে এসেছি কারণ এখানে কম দামে পাচ্ছি। ৭৫০-৮০০ টাকায় গরুর গোশত কেনার সামর্থ্য আমার নেই। কিছু টাকা কমে পাওয়ার আশায় আমি ফকিরাপুল থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে গরুর মাংস কিনলাম। ৫৯৫ টাকা দরে ৩ কেজি মাংস কিনেছি আমি। সেই কুরবানির ঈদে গরুর মাংস খেয়েছিলাম আমরা, এর পর এখন কিনলাম। এই যে এখন মাংসের দাম কমানো হলো, এতেই প্রমাণ হয় ব্যবসায়ীরা চাইলেই জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারে। কসাইদের মন নাকি অনেক শক্ত হয়, অথচ তারাই এখন নরম মনের পরিচয় দিলেন।
খলিল মাংস বিতানের বিক্রেতা মো. কবীর বলেন, ‘আগে যখন কম দাম ছিল মাংসের তখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি গরু জবাই দিতাম আমরা এবং সব মাংস বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু দাম বেড়ে যখন ৮০০ টাকা হয়ে যায়, তখন এক দিনে ৩-৪টি গরুর মাংস বিক্রি করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মাংসের দোকানে ক্রেতা আসায় কমিয়েছিল। তাই আমাদের মালিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করার। কেজিতে ১৫০-২০০ টাকা কমে বিক্রি করায় এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি গরু জবাই দিচ্ছি এবং সব মাংস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
সময়ের আলো/আরএস/