শীতের পাতা ঝরার সময় শেষ। আছে কেবল রুক্ষ কিছু ডালপালা। তবু রূপলাবণ্যের জীবনের গল্প বলে সাদা বরফের ফুল। নিজেকে সাজায়। এই ডিসেম্বরে ওদের রূপের বন্দনায় মেহেতাজ অহর্নিশ। পুরো বাড়িটিতেই রুম টেম্পারেচার অ্যাডজাস্ট করাই আছে। ঘরে বসে বুঝতে পারছে না মেহেতাজ কতটা ঠান্ডা বাইরে যাতে করে স্নোফল হচ্ছে। অবশ্য আগেই অ্যানাউন্স করা হয়েছে কখন কোথায় কতটা সময় ধরে স্নোফল হবে।
তবুও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুলোর মতো বরফ পড়া দেখতে দেখতে অতীতে ফিরে যেতে ভালোবাসে। সেই সব দিনে যেখানে তার ভাগ্য নির্ধারণের খেলা চলছিল। এমনই দিন যখন পান থেকে চুন খসে পড়াটা কষ্টের। ঠিক এভাবেই কি চলে যেতে হয়? তবুও চলে যায় তুহিন স্বাধীনতার কদিন আগেই। আজও মনের কোণে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে সে আগুন। সারাটা বছর তাকে তুষ দিয়ে ঢেকে রাখে মেহেতাজ। মুক্তিযোদ্ধা তুহিন পল্টনের ছেলে পাশাপাশি বাড়িতেই ওদের বসবাস।
তবুও লুকিয়ে চুরি করেই ওদের দেখাদেখির পালা। গোপনে চিঠি আদান প্রদান। কাছাকাছি বা পাশাপাশি কি কখনো হয়নি ওদের মিলন! সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়ে আলো আঁধারিতে পল্টনের অলিগলি পথে আড়ালে আবডালে! হাতে হাত ছুঁয়ে থাকা কতটা সময়। অঙ্গীকারবদ্ধ দুটি মানব-মানবীর প্রেম আখ্যান। দেশ স্বাধীন হলে বিজয়ের বেশে হবে গাঁটছড়া বাঁধন। সময় দিল না জীবন সেই সুখ আনন্দটুকু গ্রহণের।
যুদ্ধের শেষ প্রান্তে তখনই দুঃসংবাদ নিয়ে এলো ওমর। তুহিনের বন্ধু। হন্তদন্তভাবেই মেহেতাজের সামনে দাঁড়িয়ে।
মেহেতাজের দৃষ্টি কাড়ে। সে জানতে চায়।
‘কী হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায় ওমর ভাই? কোনো খারাপ সংবাদ?’
কান্নাভেজা কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘তোর তুহিন বেঁচে নেই। শহিদ হয়েছে। সাভারের ভয়াডুবি ব্রিজ উড়াতে গিয়ে। আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানি আর্মির একটি জিপের যে কয়জন ছিল তারাও মারা গেছে। দুপক্ষের অনেকেই আহত হয়েছে। নয়াপল্টনের কাশেম ভাই কাছ থেকে শুনে এলাম।’
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে মেহেতাজ। আজ তার ভয় নেই, নেই লাজ শরম, আছে ভালোবাসায় ভরা একটি মন যা অসময়েই চৈত্রের কাঠফাটা মাটি। বলে, ‘আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে নিয়ে যাবে ওর কাছে?’
ওমর মেহেতাজকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে, ‘রাস্তায় বের হওয়াটা এখন বিপজ্জনক।’ ওরাই অনেক ভয়ে আছে।
কী করবে কী করা উচিত ভেবে পায় না। ঘরে মা বাবা ভাই বোন সবাই জেনে গেছে ওর ভালোবাসা আজ শহিদবেদিতে। তাই বাবা মায়ের সতর্ক দৃষ্টি মেয়ের দিকে। কোনো অঘটন যেন না ঘটিয়ে বসে। লোক জানাজানি হলে মেয়েকে পাত্রস্থ করবে কীভাবে! সেই ভয়ে আছেন তারা। মেহেতাজের নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। পাগলপ্রায় দিনযাপন। মাঝে মধ্যে ওমর ভাই সে এসে সান্ত্বনা দিয়ে যায়। এই মন তো কাঁচা মাটি তা দিয়ে যে শিব গড়েছে তাকে তো ভাঙা এত সহজ নয়। পাগলপ্রায় মেহেতাজ কোথায় যাবে, কী বলবে কাকে! বুকের মাঝে কষ্ট দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হলো পাড়ার অনেকেই ফিরে এলো বিজয়ের পতাকা হাতে। সে এলো না। কথা দিয়ে কথা রাখল না। মনকে সান্ত্বনা দেয় লাল সবুজের পতাকা উপহার দিয়েছে আমাদের। কিন্তু আমি তো এখন থেকে একলা পথের পথিক। পথ চলতে যে সঙ্গীটির প্রয়োজন ছিল সে আজ হারিয়ে গেছে। জিনের মানেই বদলে গেছে। তোমাকে ছাড়া এ জীবন অর্থহীন।
ভাবনায় বেদনায় রক্তক্ষরণ। মনে ডিপ্রেশন। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। না লেখাপড়া, না ঘুরে বেড়ানো, না খাওয়া দাওয়া। এত লম্বা পথ তুহিনকে ছাড়া কীভাবে পার করবে ভাবতে ভাবতে ট্রমায় চলে যায়। বাবা মা ভাই বোন কারো কথা তার গ্রহণযোগ্য বা মনঃপূত হয় না। পাগলামিতে পেয়ে বসেছে ওকে। কী যে আবোলতাবোল বকছে! কী করবে বাবা মা ভেবে পায় না। অবশেষে ওমর পথের দিশারি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। নানাভাবে মেহেতাজকে নিজের আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করে। সফলতার সূত্র হয়ে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করেছে মেহেতাজ আর ওমর। তবু নিশ্চিত হতে পারে না মেহেতাজ। সে কি অনুকম্পা করে তাকে গ্রহণ করেছে! কতই না প্রশ্ন তার। তারপরে এলো শর্ত। মেহেতাজ বলেছে, ‘এই লোকালয়ে আছে তার পায়ের চিহ্ন। সেখানে নয় অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে। পল্টনের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকা মানুষটি এক দণ্ড তাকে বাঁচতে দেবে না। মনের বোঝাটি ঝেড়ে ফেলতে ওমরকে তার প্রস্তাব মানতে হলো।
দুজনে একদিন উড়ে যায় দূরের আশ্রয়ে। শীতের অতিথি পাখির মতো নয় গ্রীষ্মের দেশ থেকে শীতের দেশে ওদের অবস্থান দৃঢ় করে নেয়। অনেকক্ষণ যাবৎ শার্শিতে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকা মেহেতাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ওমর। একান্ত সান্নিধ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘মন খারাপ?’
মনের বিষণ্নতায় দীর্ঘশ্বাস জড়িয়েই মেহেতাজ তার নিবিড় আস্থার মানুষটির বুকের কাছে টেনে বলে, ‘পালিয়ে যত দূরেই যাই না কেন, মনের কোণে তার অবস্থান দিনে দিনে আরও দৃঢ় হয়ে গেছে। যতই চাই মুছবে না সেই অমোচনীয় দাগ।’
ওমর নির্ভরতায় নিজের কাছে টেনে নেয় মেহেতাজকে বলে, ‘আমিও কি চাই সে আমাদের কাছ থেকে মুছে যাক? সে থাকবে আমাদের অস্তিত্বে। বাংলার পথেপ্রান্তরে লাল সবুজের অবয়বে। আমাদের গর্বে আমাদের অহংকারে।
সময়ের আলো/আরএস/