কবীর চৌধুরীর পরিচয় একাধিক। বুদ্ধিজীবী এবং লেখক হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে তিনি ভেবেছেন এবং তা নিয়ে লিখেছেন। ভাবনাকে তিনি প্রকাশ করে গেছেন জীবনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের রচনা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আবার বাংলাসাহিত্যের অনেক গল্প, উপন্যাস এবং নাটক ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি যোগসূত্র স্থাপন করেছেন।
দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় তিনি গভীর মমতায় অনুবাদ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক রচনা এবং অনুবাদ মিলিয়ে কবীর চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১৭টি। তার বেশকিছু প্রবন্ধ ও অনূদিত গল্প-কবিতা ভারত, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্র-পত্রিকা এবং সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। কবীর চৌধুরী অনূদিত গল্পের সংখ্যা শতাধিক। তার প্রথম দিকের অনূদিত গল্পের মধ্যে প্রখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক এফ স্কট ফিটজিরাল্ড রচিত ‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’। অনুবাদ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘অনুবাদের ব্যাপারে আমার দুটি বিষয় সবার চাইতে আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি হচ্ছে, আসলের সঙ্গে তার যোগসূত্র কতখানি রক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ মূলের প্রতি বিশ^স্ততা কতটা রক্ষিত হচ্ছে। আর একটি হচ্ছে সাবলীলতা। বিশ্বস্ততা বজায় রেখে সুখপাঠ্য সাবলীল করতে হবে অনূদিত রচনাটিকে। এটা একটা দুরূহ কাজ। কিন্তু আমার ভাই মুনীর চৌধুরী এক্ষেত্রে একটি আশ্চর্যজনক সাফল্য অর্জন করেছেন।
বহুদিন আগে উইলিয়াম শেকসপিয়রের একটি নাটকের অসাধারণ অনুবাদ করেছেন। ‘টেমিং অব দ্য শ্রু’ এই নাটকটি ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নামে তিনি অনুবাদ করেন। এটা অসম্ভব সুন্দর অনুবাদ। এরপর শেকসপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকটি আমি এবং মুনীর চৌধুরী দুজন মিলে অনুবাদ করি। মুনীর চৌধুরী প্রায় অর্ধেকের মতো অনুবাদ করার পর আলবদরদের হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর আমি বাকি কাজটুকু সম্পাদন করি।
শেকসপিয়রের অসামান্যতা যেমন নাটকের ক্ষেত্রে, তেমনি কবিতা তথা সনেট রচনার ক্ষেত্রে। তার সনেটগুলোর অনুবাদ আমাদের দেশে বাংলাভাষায় বেশ কয়েকজন করেছেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী শেকসপিয়রের সবগুলো সনেট অনুবাদ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত শেকসপিয়রের অনেকগুলো সনেট অনুবাদ করেছেন। শেকসপিয়রের সনেট রচনার ক্ষেত্রে একটি কৌতূহলোদ্দীপক দিক আছে। তিনি তার সনেটগুলোর কোনো নামকরণ করেননি। এক, দুই, তিন এইভাবে সংখ্যানুক্রমিক সনেটগুলো রচনা করেছেন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রত্যেকটি সনেটের বাংলা নাম দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কবীর চৌধুরী বলেছেন, ‘এটা ভালোই লাগে এবং প্রাসঙ্গিক ও সুখপাঠ্য হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে আরেকটি কথা হয়তো আমরা আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করতে পারি-শেকসপিয়রের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তিনি শেকসপিয়রের ‘কমিডি অব এরসে’র অনুবাদ করেছিলেন এবং নামটিও দিয়েছিলেন চমৎকার- ‘ভ্রান্তিবিলাস’।
কবীর চৌধুরী ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ অনুবাদ করেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। অনুবাদটি প্রকাশ হয় একাত্তর সালে ব্রাইট বুক হাউস নামের একটি প্রকাশনা থেকে। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘অনন্যা’ এ উপন্যাটি দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ করে। ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ স্কট ফিটজিরাল্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ও মার্কিন কথাসাহিত্যের একটি মাইলফলক। উপন্যাসটি আকারে বড় নয়। কিন্তু এর কাহিনীবিন্যাস, চরিত্র, আবহ নির্মাণ ও ভাষাশৈলী অতি উঁচুমানের। ১৯২৫ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার পর টিএস এলিয়ট একটি চিঠিতে ফিটজিরাল্ডকে লিখেছিলেন, তিনি বইটি তিনবার পড়েছেন এবং নতুন প্রকাশিত যেকোনো ইংরেজি বা মার্কিন উপন্যাসের তুলনায় এই বই তার বেশি ভালো লেগেছে। এলিয়ট আরও লিখেছিলেন, ‘সময় পেলে আমার এই ভালো লাগার বিস্তারিত কারণ আমি আপনাকে জানাবো। প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয়েছে হেনরি জেম্স্-এর পর এই বই মার্কিন কথাসাহিত্যে একটি নতুন সোপান সংযোজন করেছে।’ তবে এলিয়ট তার এই অভিমতের ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি।
উপন্যাসটি রচিত হয়েছে কয়েকটি দৃশ্যের সমাহাররূপে, অনেকটা নাটকের মতো করে। এই শৈল্পিক কাঠামো খুব দৃঢ়, কোথাও নড়বড়ে বা টলোমলো হয়ে ওঠে না। আর উপন্যাসজুড়ে বিরাজ করে একটা মমতার পরিমণ্ডল। এটা বজায় থাকে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায়। এতে এক মহিলার মৃত্যু, চোরাকারবার, অবৈধ যৌনমিলন, সুরামত্ততা, হত্যা এবং আত্মহত্যার মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘটনাবলির মধ্য দিয়েও। গ্যাটসবির বিরাট ধনী হয়ে ওঠার পটভূমিতে কিছু অসাধু কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত থাকলেও তার স্বভাব ও সহজাত সারল্য, ঔদার্য, মাধুর্য, বন্ধুবাৎসল্য, সৌজন্য এবং অপরাজেয় রোমান্টিকতার জন্য পাঠকহৃদয়ে একটা প্রীতির আসন করে নেয়।
উত্তমপুরুষে কাহিনি বর্ণনাকারী নিক কারাওয়ে, প্রধান চরিত্র গ্যাসটবি, তার প্রিয়া ডেইজি, ডেইজির স্বামী বুকাননের বিবাহবহির্ভূত প্রণয়িনী মার্টল, মার্টলের স্বামী জর্জ উইলসনসহ সব চরিত্রই জীবন্ত। তবে পাঠকহদয়ে অধিকার করে রাখে গ্যাটসবি এবং তার কামনা ও বাসনা। উপন্যাসটির শেষ পর্বে অতিনাটকীয়তা আছে। সার্বিক বিবেচনায় এর রচনাশৈলী প্রশংসনীয়।
কবীর চৌধুরীর শেষদিকের অনূদিত গল্পের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার কথাসাহিত্যিক জে এম কোয়েৎজি রচিত দি এইজ অব আয়রন বা ‘লৌহযুগ’ উপন্যাসটি উল্লেখযোগ্য। এটি ২০১০ সালে একুশের বইমেলায় ‘একুশে বাংলা প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে দক্ষিণ আফ্রিকার নিষ্ঠুর বর্ণবাদী শাসনের এক মর্মস্পর্শী বস্তুনিষ্ঠ চিত্র ফুটে উঠেছে। কোয়েৎজি যে একজন মানবতাবাদী, বর্ণবাদবিরোধী, প্রগতিশীল, ব্যতিক্রমধর্মী ও শক্তিশালী বহুমাত্রিক লেখক-এই উপন্যাসে তিনি আবারও তা প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক বয়স্ক শ্বেতাঙ্গিনী। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত এবং অনিবার্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই সুপণ্ডিত মহিলা একসময় প্রাচীন ধ্রুপদী গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তার এক মেয়ে আছে। এই মেয়ে জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার অসহনীয় অবস্থা দেখে দেশ ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তিনি ওই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তার স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে।
কোয়েৎজি উপন্যাসটি বিন্যস্ত করেছেন কৌতূহলোদ্দীপকভাবে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ও পরিচয় পাঠক জানতে পারেন কাহিনী অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার পর। প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের অধ্যাপক মিসেস কারেন সারা জীবন বর্ণবাদ, বর্ণবাদের মিথ্যাচার, নির্যাতন ও বর্বরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে বর্ণবাদের প্রকৃত বিভীষিকার সঙ্গে তার কখনো প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেনি। এক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ব্যবস্থা তাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি দেখতে পান বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ স্বৈরশাসকরা কী নিষ্ঠুরভাবে প্রতিবাদী কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের হত্যা করছে। তখন মিসেস কারেনের মধ্যে জেগে ওঠে প্রচণ্ড ক্রোধ, লজ্জা ও ধিক্কার। তিনি একটি দীর্ঘ চিঠিতে তার আমেরিকা প্রবাসী মেয়ের কাছে নিজের জীবনের এই পর্বের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করেন। কোয়েৎজি এই উপন্যাসে মিসেস কারেন ছাড়াও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র উপহার দিয়েছেন। এদের মধ্যে আছেন মিসেস কারেনের গৃহকর্মী ফ্লোরেন্স, এক কৃষ্ণাঙ্গ, ভেকির বন্ধুজন, সর্বোপরি এক সুরাসক্ত ঘরছাড়া ভবঘুরে মানুষ যার নাম ভেরসুইল। বাস্তবিক এই উপন্যাসের অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র হলো এই ভেরসুইল- জটিলও বটে। কখন সে আন্তরিক আর কখন সে ভান করছে বোঝা কঠিন। নানা ঘটনা-অঘটনার মধ্য দিয়ে মিসেস কারেন ও ভেরসুইলের সম্পর্ক একটা চমক জাগানিয়া পরিণতি লাভ করে।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত কবীর চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে আধুনিক বুলগেরীয় কবিতা, কাহলিল জিবরানের কবিতা, সচিত্র প্রেমের কবিতা, দি গ্রেপস অব রথ, রূপান্তর, অল দি কিংসম্যান, ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সী, ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন, প্রেম ও কলেরা, চেখভের গল্প, চুম্বন, কাফকার নির্বাচিত গল্প, আহ্বান, শত্রু, পাঁচটি একাঙ্কিকা, সম্রাট জোনস, ছায়াবাসনা, সেই নিরালা প্রান্তরে, হেক্টর, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, শহিদের প্রতীক্ষায়, গডোর প্রতীক্ষায়, ওথেলো (যৌথ), জননী সাহসিকা ও তার সন্তানরা, লিসিসিট্র্যাটা, বিহঙ্গ, ভেক, শাইলোর উন্মাদিনী, মানববিদ্বেষী, ঊষা দিশাহারা ও অন্যান্য নাটিকা, ফেইড্রা, হ্যামলেট মেশিন, গন্ডার, বেকেটের তিনটি নাটক ইত্যাদি।
সময়ের আলো/আরএস/