ট্রেনটা ছুটে চলেছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। বাইরে বাতাসে ধানি ফসলের মিষ্টি সুবাস। ট্রেনের কু ঝুক ঝুক কু শব্দ বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে কেমন ছন্দময় সুর তুলছে। বিন্তি বসে আছে তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায়, জানালার ধার ঘেঁষে। ওর দৃষ্টিতে কেমন আতঙ্ক। ডাগোর কালো চোখ দুটোতে জল টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তে তা ঝরে পড়বে। জানালা গলে বিন্তির দৃষ্টি চলে গেছে দূর গ্রামের দিকে। যেখানে আকাশ আর মাটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
বিন্তি তাকিয়ে আছে অসহায়ের মতো। ভেতরে ভেতরে সে কেমন শিউরে উঠছে থেকে থেকে। সোনাইমুড়ি গ্রামের মেয়ে বিন্তি। কত না সুখে ছিল সে। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ করে মা মরে গেলে ওর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎ মায়ের সংসারে বিন্তি হয়ে ওঠে বোঝা। সারাদিন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। তবু সৎ মায়ের মন জয় করতে পারে না। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও পেটপুরে খেতে পারেনি বেচারা। কপালে জুটেছে পচা আর বাসি খাবার। তাও মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু সৎ মায়ের লাঠির গুঁতো আর চড়-লাথি সহ্য করতে পারছিল না।
তাইতো বাড়ি থেকে পালিয়েছে আজ। ঢাকায় যাওয়ার জন্য ট্রেনে চেপে বসেছে। ঢাকায় বিন্তির খালা থাকে। মগবাজার বস্তিতে। ফোনে কথা হয়েছে তার সঙ্গে। খালা অভয় দিয়ে বলেছে ঢাকায় চলে যেতে। সে কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকবে। তাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। শেফালি খালা, ওর মায়ের আপন ছোট বোন। বিন্তির জন্মেরও আগে থেকে ঢাকায় থাকে। কখনো বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। আবার কখনো পোশাক কারখানায় কাজ করে। খালা বলেছে ওকেও কোথাও কাজে দিয়ে দেবে। বাড়িতে বসে বসে সৎ মায়ের মার খেতে হবে না।
বাইরের দিকে তাকিয়ে অভিমান ঝরে পরে বিন্তির চোখ দিয়ে। আর কোনো দিনও ও ফিরে যাবে না বাড়িতে। বাবার কথা ভেবে কান্না পায় বিন্তির। অসুস্থ বাবা সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে আর খক খক করে কাশে। অসুস্থ লোকটার সঙ্গেও অনেক খারাপ ব্যবহার করে সৎ মা। তাকে ঠিক মতো খেতেও দেয় না। সারাদিন শুধু চেঁচামেচি করা আর পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে ঝগড়া করাই তার কাজ। গতকাল পাশের বাড়ির হাসি খালার সঙ্গে কি ঝগড়াটাই না করল এই মহিলা। হাসি খালার অপরাধ সে বিন্তিকে রক্ষা করতে এসেছিল। পরে গালাগাল শুনে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে বেচারা।
বিন্তির চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সুখের দিনগুলো। যখন মা বেঁচে ছিল তখন কত সুখ ছিল ওদের সংসারে। সারাদিন টুকটুক করে সংসারের কাজ করত মা। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে কায়দা হাতে পাশের মাদরাসায় আরবি পড়তে যেত বিন্তি। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মিলে খুব ভোরে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে মাদরাসায় যেত। কত মজা হতো। বাড়ি ফিরেই নাশতা খেয়ে আবারও বই হাতে চলে যেতে হতো স্কুলে। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে কত মজা, কত আনন্দ!
দুপুরে তাল পুকুরে সাঁতার কেটে ঘরে ফিরে মৌলী মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত, সে কি স্বাদ! মায়ের হাতের রান্না কি যে অসাধারণ হতো ভাবলে আজও জিভে জল চলে আসে। জলপাইয়ের টক দিয়ে পেটপুরে ভাত খেত বিন্তি। এক লোকমা বেশি খাওয়ার জন্য কত পীড়াপীড়ি করত মা। আজ সে সব যেন দুঃস্বপ্ন ওর ছোট্ট জীবনে।
বিকালে দূরের মাঠ থেকে কাজ শেষে বাবা ঘরে ফিরত বাজার করে। ওর জন্য মিঠাই আনতে ভুলত না কোনোদিনও। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাজার থেকে বাবার আনা জ্যান্ত মাছ কুটতে বসে পড়ত মা। উঠোনের দক্ষিণ দিকের শিউলী গাছের তলে বসে আপন মনে মাছ কুটত মা। ঠিক সে সময় পোষা হাঁস-মুরগিগুলোকে খোঁয়াড়ে ঢোকাতে ব্যস্ত থাকত বিন্তি। বাড়ির সামনের মাঠ থেকে গরু দুটোকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে গোয়ালঘরে বেঁধে রাখত বাবা। তারপর দ্রুত ছুটে যেত মসজিদের দিকে। নামাজ পড়তে হবে; মাগরিবের সময় চলে যাচ্ছে।
সেবার গ্রামজুড়ে সেকি বন্যা। বড় গাঙের বাঁধ ভেঙে সারা গ্রাম পানিতে ডুবে গিয়েছিল। উঁচু মাচা করে তাতে থেকেছিল বাড়ির সব লোকজন। বাবা-চাচারা নৌকোয় করে কোথা থেকে যেন খাবার নিয়ে আসত। বাচ্চাদের অনেক মজা হয়েছিল। স্কুলে যেতে হয়নি অনেক দিন। সারাদিন মাচায় বসে বসে শুধু লুডু খেলা। সাপ লুডু খেলতে গিয়ে পাশের বাড়ির হাশেম চাচার ছেলে জাহিদ ভাই শুধু চুরি করত। তা নিয়ে সে কি শোরগোল! শিরীন বুবুর নির্দেশে পরের দিকে তাকে আর খেলায় নেওয়া হতো না।
এসব স্মৃতি ভাবতে ভাবতে বিন্তির চোখে জল চলে আসে। অনেক কষ্টে কান্না আটকায় সে। কু ঝুক ঝুক কু শব্দে কেমন সুর তোলে ট্রেনটা ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। কত লোক ট্রেনজুড়ে। কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ পত্রিকা পড়ছে; কেউবা গল্পে মশগুল। কেউ আবার বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে। কেউ কেউ আবার ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু বিন্তির চোখে ঘুম নেই। বাইরের দিকে তাকিয়ে ও শুধু ভাবছে অতীতের কথা।
সময়ের আলো/আরএস/