পুরোনো বর্ষ বিদায় আর নববর্ষের আগমনের মুহূর্তটি মানুষ ঘটা করে পালন করে। এর পেছনের কারণ, একটা উপলক্ষকে সামনে এনে আনন্দযাপন। মানুষ একা বাস করে না, সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। শুধু কি মানুষ, প্রাণিজগতে গোত্রবিশেষে সবাই সমবেতভাবে থাকতে পছন্দ করে। সবার উপলক্ষ-নিরাপদে থাকা, আনন্দে থাকা। এসব ক্ষেত্রে বাঙালিরা আরও একধাপ এগোনো। তাদের পার্বণের কোনো অভাব নেই। বলা হয়-বারো মাসে তেরো পার্বণ। নিজেদের প্রয়োজনেই মানুষ এসব উপলক্ষ উদ্ভাবন করেছে। নববর্ষ পালনও তেমনই একটি আনন্দযাপনের অনুষঙ্গ বা উপলক্ষ। এটাও এক বড় পার্বণ।
নববর্ষ উদযাপনের রীতি শুধু আমাদের মধ্যে নয়, অন্য অনেক জাতির মধ্যে দেখা যায়। ভাবনায় থাকে বিগত বছরের দুঃখ-গ্লানি মন থেকে মুছে নব উদ্যমে নববর্ষ শুরু করা, নবস্বপ্নে সামনের দিনগুলো রচনা করা। এসব আয়োজনে মূলত হৃদয়ের আবেগই প্রকাশিত হয়। বড় যে-বিষয় তা হলো সামাজিকতা। এতে একের সঙ্গে অন্যের সাক্ষাৎ হয়, ভাবনা বিনিময় হয়, সুখ-দুঃখের অনুভূতির আদান-প্রদান হয় এবং সর্বোপরি হাসি-গানে মুখরিত হয় বিশেষ একটি ক্ষণ। এভাবেই বাঙালির প্রাণাবেগ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সামাজিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
নববর্ষ উদযাপনের রীতি শুধু বাঙালির মধ্যে নয়, বলা যায়-এটি এখন একটি বিশ্বজনীন উৎসব। আমরা বাঙালিরা পালন করি-বাংলা নববর্ষ, খ্রিস্টীয় নিউ ইয়ার্স ডে। ইরানিরা পালন করেন ‘নওরোজ’। একসময় ভারতেও ‘নওরোজ’ উদযাপিত হতো। ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়- ‘বৈশাখী উৎসব’, ‘হোলি উৎসব’ ইত্যাদি; চীনারা উদযাপন করে ‘চুন জি’-চান্দ্র নববর্ষ; থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান্ত’। তার সঙ্গে বাংলাদেশে উদযাপিত চৈত্রের শেষদিন- চৈত্রসংক্রান্তির মিল আছে। যে যেভাবেই পালন করুক না কেন, এর পেছনে রয়েছে সামাজিক আচার, ঐতিহ্যগত বিশ্বাস।
আগামী সোমবার খ্রিস্টীয় নববর্ষ ২০২৪-এর প্রথম দিন। বলা যায় বর্তমান বছরের শেষ মধ্যরাতে, নববর্ষ শুরুর প্রথম ক্ষণে বিশ্ব মেতে উঠবে মহা আনন্দে। এটি ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ বলে পরিচিত সর্বমহলে।
দিন-ক্ষণ গণনায় ক্যালেন্ডারও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। বহু দেশে নিজেদের ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা রয়েছে। আমাদেরও আছে নিজস্ব পঞ্জিকা, নববর্ষ। এসব পঞ্জিকার উদ্ভব কর্মের প্রয়োজনে; বিশেষ করে কৃষিকর্মের সুবিধার্থে। ইতিহাস বলে, প্রাচীনকালে মিসরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল। তাদের হাত ধরে আসে ক্যালেন্ডারের প্রথম ধারণা। পরবর্তী সময়ে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিসরীয় ক্যালেন্ডারে কিছু পরিমার্জন করে নিজ সাম্রাজ্যে প্রচলন করেন। এটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিতি পায়। তখন ক্যালেন্ডারের মাস-দিনের নামকরণও করা হয় রোমান দেবদেবীর নামানুসারে। এর আগে মাসের নাম ভিন্ন ছিল। আগের নিয়মে প্রথম মাস ছিল মার্চ। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারিকে প্রথম মাস ধরে ক্যালেন্ডার সাজানো হয়। ‘জানুস’ নামের দু-মুখী দেবতার নামে এই নাম। তাদের বিশ্বাসমতে, জানুসকে বলা হতো ‘গড অব ডোরস’ অর্থাৎ শুরুর ঈশ্বর। এই দেবতার একটি মুখ ছিল অতীতের দিকে, আরেক মুখ ভবিষ্যতের দিকে। কথিত আছে, অতীত-ভবিষ্যত-দেখা জানুস দেবতার নামে শুরু হলো ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস জানুয়ারি।
পরবর্তীকালে পোপ দ্বাদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের গণনায় কিছু পরিবর্তন আনেন। বর্তমানে ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার নামে সারা বিশ্বে চালু রয়েছে। সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫.২৫ দিন, অর্থাৎ ৪ বছরে একদিন বেশি। সময় গণনার হিসাব নির্ভুল করার জন্য প্রতি চার বছরে ‘লিপ ইয়ার’ হিসাব এই ক্যালেন্ডারে যুক্ত করা হয়। তখন থেকে বলা হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।
কেউ বলে খ্রিস্টীয় নববর্ষ, কেউ বলে ইংরেজি নববর্ষ। যা-ই বলা হোক না কেন, বিশ্ববাসী এদিন পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে স্বাগত জানায়। এটা প্রচলিত রেওয়াজ। যেকোনো রেওয়াজ দাঁড়ায় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থেকে। এই রেওয়াজই পরিণত হয় সংস্কৃতিতে।
নববর্ষ উদযাপন এখন বিশ্বসংস্কৃতির অংশ। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এই দিনে সব বিভেদ ভুলে একত্রে গায়, নাচে, উৎসব করে। এটা যদি বিশ্বভ্রাতৃত্বের অংশ হয়ে উঠত, বিশ্বকল্যাণের আধার হয়ে উঠত, পৃথিবীর হানাহানি বন্ধ করে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে পারত মানুষের কাছে, তাহলে কল্যাণ-পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হতো। এই বার্তা পৌঁছে যাক বিশ্ববিবেকের কাছে-‘নিউ ইয়ার্স ডে’র এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা।