মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই মাস পরের ঘটনা।
তখন আমরা অনেক ছোট।
আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলিম লীগার। যুদ্ধের আগে ভালো ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর পর পাল্টে যায়।
হিংস্র দানবের মতই।
বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। ঠাকুরমাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেন। কত আপন ছিলেন। বিপদে আপদে দেখতেন। এখন পুরো উল্টো।
তিনি এখন রাজাকারের কমান্ডার। আবার চেয়ারম্যান। গাঁয়ের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে তৈরি করেছেন রাজাকার বাহিনী। ওদের হাতে দিয়েছেন অস্ত্র। রাইফেল, ছুরি, কিরিচ, বল্লম।
আমাদের পাশের বাড়ির অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে গেছে। তাতে তিনি ভীষণ রেগে আছেন। পাকিস্তানি সেনারা তার বাড়িতে আসে। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে। খবর নেয়, মুক্তিবাহিনীতে কারা গেছে, কোন বাড়ি থেকে গেছে।
এক দিন দুপুরে অনেক পাঞ্জাবি সৈন্য আমাদের বাড়িতে আসে। সঙ্গে চেয়ারম্যান। বাবাকে ডাকে। বাবা তখন শুয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের ডাকে বাবা বাইরে আসেন।
চেয়ারম্যান বলেন, খুব ভালো আছিস বিমল। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে দারুণ সখ্য। ওদের খাওয়াস। খাতির করিস। তোর পাশের বাড়ি থেকে ক’জন গেছে মুক্তিবাহিনীতে। জানিস?
না না, আমি কিছুই জানি না চেয়ারম্যান সাহেব।
বাবার গালে থাপ্পড় মারে চেয়ারম্যান। গাল দেয় অকথ্য ভাষায়।
সঙ্গে আসা রাজাকারদের হুকুম দেয়, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দে।
বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা কেরোসিন ছিটায় সারা বাড়িতে। মা ছোট বোনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
দিয়াশলাইর কাঠির আগুনে বাড়িতে আগুন ধরে।
দাউদাউ জ্বলতে শুরু করে।
বেশিক্ষণ লাগেনি পুরো বাড়ি জ্বলতে। সঙ্গে জ¦লে পাশের বাড়িও।
পাকিস্তানি সেনা, চেয়ারম্যান, রাজাকারের অট্টহাসিতে সারা উঠোন ভরে যায়। মা-বাবাকে ঘরের একটি জিনিসও বের করতে দেয়নি ওরা।
আমি, মা, বাবা, ছোট বোনটি কাঁদি। কেঁদে কেঁদে দেখতে থাকি সবার প্রিয় বাড়িটি পুড়ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।
পাড়ার কেউ আগুন নেভানোর জন্য এগিয়েও আসে না ভয়ে।
সবাই যার যার ঘরের ভেতরে ভয়ে বসে থাকে।
আগুন জ্বলছে। বাড়ির দরজা, জানালা, টিন। আমরা সবাই উঠোনে বসে আগুন জ্বলা দেখি।
রাতে কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। কী খাচ্ছি, কেমন আছি? জিগ্যেস করে না।
চার-পাঁচ দিন উঠোনে কাটে আমাদের।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট বেড়ে যায়। রাজাকারের, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমে আসে।
পাশের বাড়ির বিজয়সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আসে রাতে। আমাদের বাড়ি, তাদের বাড়ি পোড়া দেখে বাবাকে প্রশ্ন করে, কাকা, এটা কি আমাদের সেই বাড়ি! তোমাদের বাড়ি, আমাদের বাড়ি কীভাবে পুড়ল, কারা পুড়ল?
বাবা বিজয়দার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। ছোট ছেলের মতো কাঁদে।
বাবাকে কাঁদতে দেখে আমিও কাঁদি।
একসময় কেঁদে কেঁদে বলি, চেয়ারম্যান, রাজাকারেরা আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।
আমার কথা শুনেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আলম আকাশে স্টেনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। উঁচু গলায় বলতে থাকে, রাজাকারের বাচ্চা চেয়ারম্যান আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। চল সবাই চল।
মুক্তিবাহিনীর পুরো দলটি হনহন করে বেরিয়ে পড়ে। বাবা আমাকে বলে, কী প্রয়োজন ছিল বিজয়কে বলার। আবার এসে আমাদের গুলি করলে কে বাঁচাবে?
ঠিক তখনই গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে গ্রাম।
চেয়ারম্যানবাড়ির দিক থেকে গুলির শব্দ আসে।
গুলির শব্দ থামে না। পাকিস্তানি সেনারা ছিল না। রাজাকারের পুরো গ্রুপটাকে চেয়ারম্যানসহ ভারী অস্ত্রে ঝাঁঝড়া করে দেয় মুক্তিবাহিনী।
পুরো গ্রাম শান্ত, নিথর।
কমান্ডার নুরুল আলমসহ মুক্তিযোদ্ধারা আবারও আসে। এবার নুরুল আলম নিজেই বাবাকে বলে, কাকা, সবাইকে শেষ করেছি। ওরা আর আসবে না। আমরাও আর যাচ্ছি না। এ গাঁয়েই থাকব।
নুরুল আলম, তোমরা কি পাঞ্জাবিদের সঙ্গে পারবে? ওদের কত ভারী অস্ত্র আছে জান?
কাকা, আমাদেরও আছে। ভয় নেই। আমাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনী আছে। দুয়েক দিনের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে।
তুমি কীভাবে জানলে?
আমার কাছে তাজা খবর আছে কাকা।
কী জানি বাপু!
পরের দিন থেকে গাঁয়ে কোনো যুদ্ধ নেই। বিকাল থেকে শুরু জয়বাংলা, জয়বাংলা ধ্বনি। হাটেবাজারে, পথেঘাটে।
সকাল থেকে রেডিওতে বারবার খবরে বলছে, পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
সময়ের আলো/আরএস/