প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সারা দেশে বই উৎসব হয়। এবারও হবে। নির্বাচনি প্রচার জোয়ারে এ বছর বই উৎসবের আনন্দ যাতে মøান না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সেদিকে খেয়াল রাখবেন। অভিভাবকদের শিক্ষাব্যয় হ্রাস করার জন্য সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করা শুরু করেছিল। একসময় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া হতো। এখন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের একটি বড় সফলতা বলা যেতে পারে। এর পেছনে সরকারের বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এর সুফল কতটা ভোগ করতে পারে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা? এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত থাকলেও বাস্তবতা হলো বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাওয়ার পরও অভিভাবকদের বই কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তার সীমা থাকে না। দুশ্চিন্তার সংগত কারণ হলো-শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষক সমিতিগুলো অতি উচ্চমূল্যের কিছু গাইড বই বেসরকারিভাবে পাঠ্যতালিকাভুক্ত করে। বেসরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা এই গাইড বইগুলোর ওপর জোর দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো কিনতে বাধ্য হয়।
টেক্সটবুক বোর্ড কর্তৃক বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ বই দুটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের প্রকাশিত অতি উচ্চমূল্যের গ্রামার ও ব্যাকরণ নামক দুটি বই প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কিনতে হয়। অন্যান্য বিষয়ের গাইড বইও কিনতে হয়। প্রকাশকরা তেমন কোনো পরিবর্তন না করে কিংবা সামান্য কিছু পরিবর্তন করে নতুন মোড়কে বইগুলো বাজারে ছাড়ে। গাইড বইয়ের প্রকাশক আর শিক্ষক সমিতি মিলে বইগুলো কিনতে বাধ্য করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবই পড়ে থাকে টেবিলের এক কোণে। শিক্ষার্থীদের কাছে গৌণ হয়ে যায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই আর মুখ্য ও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে উচ্চমূল্যের গাইড বই।
এই বাস্তবতায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের মহৎ উদ্যোগটি যে লক্ষ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল তা পূরণ হয়ে ওঠে না। মুখে যাই বলা হোক না কেন, অভিভাবকরা বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের সুফল ভোগ করতে পারেন না খুব একটা। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং করতেও দেখা যায় না। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদার উচ্চমূল্যের গাইড বই বিক্রি হয়। প্রথম শ্রেণি থেকে গাইডনির্ভর হয়ে যায় কোমলমতি শিশুরা। শিক্ষক সমিতি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। শোনা যায় অনেক শিক্ষক সমিতির নিজস্ব তহবিলে নাকি কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। এর একটা অংশ শিক্ষকদের চাঁদা থেকে এলেও বেশিরভাগ টাকাই নাকি আসে প্রকাশকদের কাছ থেকে। যে প্রকাশক বেশি টাকা অফার করে শিক্ষক সমিতি সে প্রকাশকের বই পাঠ্য করে। এ ক্ষেত্রে মান যাচাই করা হয় না খুব একটা। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো মানসম্পন্ন বইটিও কিনতে পারে না। এ পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সরকার বিভিন্ন সময় গাইড বই নিষিদ্ধ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষকরা গাইড বই পড়াতে পারবে না মর্মেও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সবাই নিজ নিজ বাণিজ্যিক স্বার্থে আইনকে বাইপাস করে।
বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান করার কথা বলা হলেও পরোক্ষভাবে কিন্তু পাঠ্যবই প্রকাশের সব ব্যয়ভার বহন করে এ দেশের সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। অভিভাবকদের টাকা ট্যাক্সের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচ করে সরকার। সে দিক থেকে অভিভাবকরাই সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের ব্যয়ভার বহন করে। আবার উচ্চমূল্যের গাইড বই কেনার ব্যয়ভার বহন করতে হয় অভিভাবকদেই। তা হলে শিক্ষাব্যয় হ্রাস হলো কীভাবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাপ সৃষ্টি করে উচ্চমূল্যের গাইড বই কিনতে বাধ্য করার ফলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান করার বিষয়টি অর্থহীন হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করার পরও বই কেনা বাবদ অভিভাবকদের ব্যয় মোটেও কমে না। সম্প্রতি কাগজের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বইয়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে প্রকাশকদের কোনো ক্ষতি নেই। শিক্ষক সমিতিকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষকদের ব্যবহার করেই প্রকাশকরা শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারছে উচ্চমূল্যের গাইড বই। শিক্ষকরা বললেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষক নির্দেশিত বইটি কিনে দিতে বাধ্য হন।
তবে আশা করা যায়, নতুন কারিকুলাম এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে অভিভাবকদের রেহাই দেবে। পাঠ্যবইকে গৌণ করে রেখে পরিকল্পিতভাবে উচ্চমূল্যের গাইড বই চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ মিলবে না নতুন কারিকুলামে। নতুন কারিকুলাম অনুসারে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দেওয়া কোনো গাইড বা সহায়ক বই থাকবে না। কোনো শিক্ষার্থীর গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রয়োজনও হবে না। দলগতভাবে বা দুজন মিলে সব সমস্যার সমাধান করবে। প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য কিংবা ‘এ’ প্লাস পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হবে না কোনো শিক্ষার্থীকে। বইয়ের বোঝা কমবে। কোনো কিছু না বুঝে মুখস্থ করার প্রয়োজন পড়বে না। ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে নতুন প্রজন্ম। নতুন কারিকুলামের এ ভালো দিকগুলোকে বিবেচনায় আনছেন না অনেক অভিভাবক। এমনকি শিক্ষকরাও ভালোভাবে নিচ্ছেন না বিষয়টি। অনেক শিক্ষক নতুন কারিকুলামের সমালোচনা করছেন। অভিভাবকদেরও আন্দোলনে নামতে দেখা গেছে। তারা মানববন্ধন করেছেন। এর পেছনে গাইড বইয়ের প্রকাশক ও কোচিংবাণিজ্যে যুক্তদের হাত আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষামন্ত্রী সংসদে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, কোচিং ব্যবসায়ী কিংবা নোট-গাইড ব্যবসায়ীরাই নতুন কারিকুলামের বিরোধিতা করছে। কারণ তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছে এ কারণে যে এতে তাদের কোচিং ব্যবসা উঠে যাবে। কোচিং-গাইড বাণিজ্য থাকা বা না থাকার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নতুন কারিকুলাম দক্ষ জনশক্তি তৈরি করবে কি না?
বর্তমান বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হলে তাদের ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যেই নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। তবে নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রায়োগিক শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ জোর দিয়ে চালু করা হয়েছে নতুন কারিকুলাম। এর সুফল লাভ করতে কিছু দিন সময় লাগবে। সবক্ষেত্রেই দেখা যায়, নতুন কিছু চালু করার সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মত ও ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়। একটি শ্রেণি বিদ্যমান ব্যবস্থা মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। আর একটি শ্রেণি নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। মূল্যবোধের ভিন্নতা থেকে এ ধরনের সংকট দেখা দেয়। বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে সমাজ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। এগিয়ে যেতে হলে পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে কায়েমি স্বার্থবাদী বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন শিক্ষক সমিতিগুলোর পক্ষে সহায়ক কোনো বই বেসরকারিভাবে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকবে না। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর্থিকভাবে হয়রানি হতে হবে না। কোচিংবাণিজ্য ও নোট-গাইড ব্যবসার দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে।
কল্পনাবিলাসী ভাবাবেগ ও মনোজাগতিক উন্নতির তাত্ত্বিক দিকগুলোর পাশাপাশি যাপিত জীবনের নানা বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশে^ ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন অপরিসীম। সাইকেল চালানোর নিয়মকানুন পড়ার টেবিলে বসে শেখার বদলে সাইকেল নিয়ে মাঠে গেলে সাইকেল চালানোটা দ্রুত শেখা যায়। চালাতে চালাতে নিয়মকানুনও শেখা হয়ে যায়। এই ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষাই জীবনমুখী শিক্ষা। নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের সেদিকেই নিয়ে যাবে। কোচিং ও গাইডনির্ভরতা থেকে মুক্তি পাবে শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো শাখা না থাকাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার চাপমুক্ত ও আনন্দদায়ক এ শিক্ষা কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে আরও বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
সময়ের আলো/আরএস/