ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ক্রেতাহীনতায় বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা
প্রকাশ: সোমবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৪, ২:২৯ এএম  (ভিজিট : ৭৩৪)
বিদায়ি ২০২৩ সালে পুঁজিবাজারে লেনদেনে অংশ নেওয়া যত প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর বেড়েছে ও কমেছে, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রেতার অভাবে অবহেলিতভাবে পড়ে ছিল। ফ্লোর প্রাইসের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ছাড়া বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী তেমন একটা আসেনি। পাশাপাশি সূচকেও মিশ্র প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।  

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে মাত্র দুটি কোম্পানি। এক বছরে এত কম আইপিও আর দেখা যায়নি দেশের বাজারে। এ ছাড়াও হ্রাস পেয়েছে বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারীর সংখ্যা। এক বছরে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা কমেছে ৯১ হাজার ২০৬টি।

বছরজুড়ে দেখা গেছে শক্ত মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতাহীনতা। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো আটকে আছে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইসে। আর বন্ধ বা উৎপাদনে না থাকা কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। লেনদেনেও এগিয়ে অতিদুর্বল এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। বন্ধ কোম্পানি চালু বা পর্ষদ পুনর্গঠন-সংক্রান্ত বিএসইসির নেওয়া উদ্যোগকে ঘিরেই ২৪৪ দিনের বাজারে দেখা মিলেছে কারসাজি চক্রের সক্রিয়তা।

করোনাকালে (২০২০-২০২১) টানা দুই বছর প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। তবে এর পরের বছর ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। আর ২০২৩ সালে আইপিওতে নেমেছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ধস।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা দুই কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- মিডল্যান্ড ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। দুটি কোম্পানিই স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। অর্থাৎ দুটি কোম্পানির উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ৮৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বছরজুড়েই ফ্লোরের তলানিতে আটকে থাকা পুঁজিবাজারে অব্যাহত ছিল পতনের ধারা। অব্যাহত দরপতনে পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। বিনিয়োগকারীদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সাক্ষী হয়েছে পুঁজিবাজার।

এ ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে দেশের বাইরে বিএসইসির পক্ষক্ষ থেকে একটি সম্মেলন করা হলেও তার প্রভাব এখনও দেখা যায়নি পুঁজিবাজারে। তবে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ তথা দেশের বাজার ও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখা গেছে বিদেশিদের।

বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানোর ফলে কমেছে বিও হিসাবের সংখ্যা। গত বছরে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ১২৯টি। যা চলতি বছরের ডিসেম্বরে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৯টিতে। অর্থাৎ এক বছরে বিও হিসাব কমেছে ৯১ হাজার ২০৬টি।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৯টি। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাবের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ১২৩টি।

এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিও হিসাব খোলার পরিমাণ ৮.৭১ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব খোলার পরিমাণ কমেছে ৪.৬৭ শতাংশ, নারী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব খোলার পরিমাণ কমেছে ৫.৭৬ শতাংশ।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পুরুষ বিনিয়োগকারীর মোট বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৯০ হাজার ২২২টি। যা ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরুষ বিনিয়োগকারীর মোট বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭৪টি। অর্থাৎ পুরুষ বিনিয়োগকারীর বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৬৪ হাজার ৯৪৮টি বা ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

অন্যদিকে ২০২০ সালে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দায়িত্ব নেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি বন্ধ বা লোকসানি কোম্পানি সচল ও পর্ষদ পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নেয় বিএসইসি। লক্ষ্য, কোম্পানিগুলো মুনাফায় ফিরলে লাভবান হবে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীরা।

এর মধ্যে বাংলাদেশ মনস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, তমিজুদ্দিন টেক্সটাইল, মুন্নু ফেব্রিকস, সোনালী পেপার এবং পেপার প্রসেসিং এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ওটিসি মার্কেট থেকে মেইন বোর্ডে ফেরানো হয়। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ওয়াইমেক্স ইলেক্ট্রোড এবং ইয়াকিন পলিমারের মালিকানায় বদল আসে।

এ ছাড়া ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ, আলহাজ টেক্সটাইল, ফুয়াং ফুডস, এমারেল্ড অয়েল, অ্যাসোসিয়েটড অক্সিজেন, অগ্নি সিস্টেমস, সিএন্ডএ টেক্সটাইলস, ফ্যামিলিটেক্স, বিডি ওয়েল্ডিং ইলেক্সক্ট্রোডস, ফারইস্ট ফাইনান্স, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, রতনপুর স্টিল রিরোলিং মিলস, ফাস ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট ফাইনান্স এবং ইউনাইটেড এয়ারের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু কারসাজি চক্র এসব পরিবর্তনকে ইস্যু বানিয়ে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়াচ্ছে। যা পরে বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে কেটে পড়ছে তারা।
পুরো বছরই শক্ত মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারে দেখা গিয়েছে ক্রেতাহীনতা। যার ফলে কোম্পানিগুলো আটকে আছে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইসে। আর বন্ধ বা উৎপাদনে না থাকা কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। লেনদেনেও এগিয়ে অতিদুর্বল এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার।

তবে কারসাজির অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেদের অবস্থানের পক্ষেক্ষ মত বিএসইসির। শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য ও লেনদেন বৃদ্ধির ঘটনাকে কারসাজি বলতে নারাজ এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বলছে, শেয়ারের মূল্য ঠিক করা বিএসইসির দায়িত্ব নয়।

এ ছাড়াও, ফ্লোর প্রাইস থেকে বাজারকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনা, বাজারে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি এবং বাজারে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আশা-ভরসা বছরজুড়েই দিয়ে এসে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাজারে মন্দা পরিস্থিতির কারণ হিসেবে বিগত কয়েক বছরের বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করেছে কমিশন।

পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ইক্যুইটির পাশাপাশি নতুন পণ্যভিত্তিক বৈচিত্র্যময় বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলাসহ পলিসিগত বাজারবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন।

২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর হওয়ার লক্ষ্যে নতুন বৈচিত্র্যময় পণ্য হিসেবে এসএমই প্ল্যাটফর্ম, অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি), এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ), ট্রেজারি বন্ড, কমোডিটি ও ডেরিভিটিভস এক্সচেঞ্জ পুঁজিবাজারে সংযুক্ত করাসহ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। তবে, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ও সূচক বিবেচনায় তা দৃশ্যমান না হলেও ভবিষ্যতে এর সুফল বিনিয়োগকারীরা পাবেন বলে মনে করছে কমিশন।

সার্বিক মিশ্রাবস্থার মধ্যে দিয়ে বছরের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেনে ইতি টেনেছে পুঁজিবাজার। পুরো বছরের বাজার পর্যালোচনা করে গত বছরের তুলনায় বড় নিম্নমুখী পরিবর্তন দেখা গেছে লেনদেনে। তবে বেড়েছে বাজার মূলধন।

এ ছাড়াও ২০২৩ সালে বেড়েছে ডিএসইর মূল সূচক ডিএসইএক্স এবং শরিয়াহ সূচক বা ডিএসইএসের হার। তবে কমেছে ডিএসই-৩০ এর হার। চলতি বছর ডিএসইএক্সের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৩৬৭ দশমিক ৪২ পয়েন্ট এবং সর্বনিম্ন অবস্থান ছিল ৬ হাজার ১৭৭ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট।

এ বছর দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট লেনদেন হয়েছে ২৪৪ দিন। ৬৫৪টি শেয়ার লেনদেনে অংশ নিয়েছে। যার মাঝে ৩৫৫টি কোম্পানি, ৩৪টি মিউচুয়াল ফান্ড, ৮টি ডিবেঞ্চার এবং ২৫৪টি বন্ড রয়েছে।

অন্যদিকে দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) শেষদিনে বেড়েছে দুটি সূচকের মান। বৃহস্পতিবার সিএসইতে সিএসই-৩০ সূচক ৮ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট ও সিএসই-৫০ সূচক ১ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১২ হাজার ৩০৪ দশমিক ৫২ পয়েন্ট ও ১ হাজার ২৯৯ দশমিক ৪২ পয়েন্টে।
তবে সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট, সিএসসিএক্স সূচক ১ দশমিক ৬০ পয়েন্ট ও সিএসআই সূচক ২ দশমিক ০০৫ পয়েন্ট কমে যথাক্রমে অবস্থান করছে ১৮ হাজার ৫২০ দশমিক ১৩ পয়েন্টে, ১১ হাজার ৭৬ দশমিক ৪১ পয়েন্টে ও ১ হাজার ১৭৮ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে।

সময়ের আলো/আরএস/ 







https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close