ই-পেপার সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রহত্যার ৫০তম বার্ষিকী-কড়চা
প্রকাশ: সোমবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৪, ১০:১৪ এএম  (ভিজিট : ৮১৮)
১৯৭২ সালের মধ্য-ডিসেম্বরে পরাজয়ের প্রাক্কালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়োজিত করে ভিয়েতনামে আক্রমণ তীব্রতর করে। ভিয়েতনাম এশিয়ার মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত একটি দীর্ঘ সরু ভূখণ্ড। চীনা ভাষায় ভিয়েতনাম শব্দের অর্থ ‘আরও দক্ষিণে’। চীনের দক্ষিণে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সেই দেশের ওপর ছিল আশপাশের সকল পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের লোলুপ দৃষ্টি। যে যখন সুযোগ পেয়েছে, থাবা মেরেছে।

ভিয়েতনামের মানুষ ১৯৪০ সাল থেকে একটানা জাপান, জার্মান, ফরাসি ও সবশেষে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯৬৫ সাল থেকে ভিয়েতনামে ৭০ লক্ষ টনেরও বেশি বোমা ফেলা হয়। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বোমার তিন গুণেরও বেশি। আমেরিকা তখন সেখানে নির্বিকারচিত্তে মানুষকে হত্যা করে, জনপদ ধ্বংস করে, রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে শস্যের মাঠ পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। যত প্রকার সর্বনাশা মারণাস্ত্র মানুষ আবিষ্কার করেছে, একমাত্র পারমাণবিক বোমা ছাড়া, তাদের সবই সেখানে প্রয়োগ করা হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সেখানে এমন কোনো গাছ ছিল না যেখানে মার্কিন বোমারু বিমানের স্প্লিন্টারের ক্ষতচিহ্ন ছিল না। তবে এসবের কিছুই শেষ পর্যন্ত মুক্তিপাগল ভিয়েতনামিদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষের সঙ্গে শামিল হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোও তখন ভিয়েতনামীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ও সমর্থন জ্ঞাপনে এগিয়ে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ [ডাকসু] ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে পয়লা জানুয়ারি ১৯৭৩ ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালন করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য তাদের একটি মিছিল ঢাকার মতিঝিলে আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে যাওয়ার পথে তোপখানা রোডে প্রেসক্লাবের বিপরীতে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের [ইউএসআইএস/ইউসিস] সামনে পুলিসের গুলিবর্ষণের শিকার হয়। তাতে দুজন ছাত্র নিহত ও ছয়জন আহত হয়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ছাত্র-হত্যা।

পুলিসের নির্লজ্জ গুলিবর্ষণ ও ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে পরদিন মঙ্গলবার ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকার সংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী রাজপথ পরিণত হয় জনতার স্রোতের বাধ না-মানা জোয়ারে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র তালা ঝোলে পূর্বদিন মধ্যাহ্ন থেকে। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পিকেটিং-এর প্রয়োজন হয়নি। এমন সফল হরতাল ইতোপূর্বে হয়ত চোখে পড়েনি। হরতাল শেষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র-জনসমাবেশ। সেখানে ৭ দফা কর্মসূচি দেওয়া হয়। এছাড়াও তৎকালীন ডাকসু সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছাত্রের রক্তে হাত কলঙ্কিত করায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর পক্ষ হতে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রত্যাহার ও ডাকসুর ‘আজীবন সদস্যপদ’ বাতিল করার ঘোষণা দেন এবং তাকে ‘জাতির পিতা’ না বলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

এর ফলে স্বভাবতই সরকার ও সরকারি দল-অঙ্গদল ক্ষিপ্ত হয় এবং আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটূক্তি’, ‘অশোভন মন্তব্য’ সহ্য করা হবে না ঘোষণা দিয়ে পাল্টা হিসেবে তারা ‘ডাকসু বাতিল’ ঘোষণা করে, ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ [মোজাফফর] অফিসে হামলা, লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। একইসঙ্গে তারা প্রায় সব জেলায় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন এবং কোথাও সিপিবি অফিসে ও মিছিলে হামলা চালায়। ছাত্র হত্যার বিবরণ দিয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় ‘টেলিগ্রাম’ বের করায় প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ও নির্বাহী সম্পাদক আবদুল তোয়াব খানকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ছাত্র ইউনিয়ন পূর্ব ঘোষিত ৬ জানুয়ারির সমাবেশ ও ন্যাপ ৭ জানুয়ারির জনসভা স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

পরে ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৩ সন্ধ্যায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা, বিভিন্ন ছাত্র সমস্যা ও দেশের অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে’ আলোচনা করায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে [আবদুল মান্নান] দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া, বর্তমান স্থান [তোপখানা] থেকে ইউএসআইএস সরিয়ে নেওয়া, ভিয়েতনাম সরকারকে ঢাকায় দূতাবাস খোলার অনুমতি দেওয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান, আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও গুলি বর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি অবিলম্বে কাজ শুরু করার ঘোষণা দেওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। বাহুল্য হলেও বলে রাখা ভালো, পয়লা জানুয়ারি ১৯৭৩-এর ভিয়েতনাম সংহতি দিবসের ‘এই দুঃখজনক ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু কবে কাকে নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয় তা যেমন জানা যায়নি, তেমনি কোনো তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।

এ ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও লেখক বিভূরঞ্জন সরকার বলেন, সেদিন ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর নেতারা আশা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার জন্য তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাবেন, গুলিবর্ষণের নিন্দা করবেন এবং যেসব পুলিশ সদস্য গুলিবর্ষণ করেছে কিংবা যদি ওপরের কেউ গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিয়ে থাকে তাহলে তাদের শনাক্ত করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন। কিন্তু তা হয়নি। বঙ্গবন্ধু যে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মর্মাহত হয়েছিলেন, যেটা ওয়াজেদ মিয়া তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন লক্ষ করা যায়নি।

১৯৭৩ সালের বর্ষ শুরুর ঘটনাবলিতে বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতির বিশেষ করে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়, জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, অগ্রগতির মোড় ঘুরে যায়। বলা যায়, এর পর আর তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি। সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ এ দেশে গড়ে ওঠা বামপন্থি রাজনীতির ভিত্তিটাকেই নড়বড়ে করে দেয়

২ জানুয়ারি সারাদেশে স্বতস্ফূর্ত সফল হরতাল পালিত হলেও তার পরদিন থেকে মুজিববাদীদের হামলায় টিকতে না পেরে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যত পিছু হটতে থাকে। ৩-৫ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলনের কিছু রুটিন কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তারা এমন কৌশল গ্রহণ করে যেন ছাত্র লীগের সঙ্গে মুখোমুখি না হতে হয়। ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিলকালে হামলার শিকার হলে ছাত্র ইউনিয়ন পরদিনের [৬ জানুয়ারির] বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠেয় পূর্ব ঘোষিত সমাবেশ বাতিল ঘোষণা করে। এ ঘোষণা আন্দোলনের আগুনে পানি ঢেলে দেয়।

এদিকে ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে ন্যাপ আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। মনে হয়, যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার ফলে সৃষ্ট উচ্চাসা ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ নেতৃত্বকে কিছুটা অস্থিরচিত্ত করে তোলে। অন্যদিকে এ কথা সকলেরই জানা এবং সরকারি প্রশাসন ও শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও জানতেন, ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরেই তৎকালীন সদ্যসৃষ্ট পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। হয়তো সেই আশঙ্কায় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনকে অঙ্কুরেই দমন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বামপন্থিদের অস্থিরচিত্ততা ও সরকারের অসহনশীলতা প্রধানত এই দুইয়ে কারণে সংঘটিত হয় বাংলাদেশে ছাত্রহত্যার মতো মর্মস্পর্শী বিয়োগান্ত ঘটনা, প্রতিবাদী আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদী ধরনের আক্রমণ। এসব ভোলার নয়।

১৯৭৩ সালের বর্ষ শুরুর ঘটনাবলিতে বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির বিশেষ করে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়, জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, অগ্রগতির মোড় ঘুরে যায়। বলা যায়, এর পর আর তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি। সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ এ দেশে গড়ে ওঠা বামপন্থি রাজনীতির ভিত্তিটাকেই নড়বড়ে করে দেয়।

২০২৩ সাল ভিয়েতনাম সংহতি দিবসের ৫০তম বার্ষিকী। মতিউল-কাদেরের শহিদ হওয়ার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে তাদের সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ী ও আত্মীয়-পরিজন চায়, পয়লা জানুয়ারির শহীদদের ও পুরোপুরি সুস্থ না-হওয়া আহত পরাগ মাহবুবকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক, জাতীয় বীর ঘোষণা করা হোক। পয়লা জানুয়ারি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দিবস হিসেবে সরকারিভাবে পালন করা হোক। শহীদদের স্মরণে তোপখানা সড়কটির নামকরণ করা হোক ‘মতিউল-কাদের সড়ক’। দুই শহীদের কবরকে চিহ্নিত ও সুরক্ষিত করে রাখা হোক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চামেলি হাউস [দি চামারি] ও জাতীয় ঈদগাহ্র মধ্যবর্তী ত্রিমোহনায় [চাইলে কদমফুল ফোয়ারাটিকে অঙ্গীভূত করে] একটি সুউচ্চ দৃষ্টিনন্দন সংহতি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হোক, যে স্মৃতি স্তম্ভ বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে এবং পৃথিবীব্যাপী আগ্রাসন নিপীড়ন শোষণ নির্যাতন বিরোধী সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

উল্লেখ্য, গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ভিয়েতনাম সরকার ২০০২ সালে শহীদ [দ্বয়] মীর্জা কাদেরুল ইসলাম ও মতিউল ইসলামকে ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদা দান করে ও সে দেশের দুটি রাস্তার নাম এই দুই বীরের নামে নামকরণ করে।

[লেখক : সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী]


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close