ই-পেপার সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জন পিলজারের জন্য শোকগাথা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৪, ১:৩২ এএম  (ভিজিট : ৬৫০)
অনুসন্ধানী সাংবাদিক জন পিলজার ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ সময়ে এসে মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তিতুল্য এই সাংবাদিক ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা।

পিলজার এক সময়ের আলোচিত প্রতিষ্ঠান উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে মুক্তি দেওয়ার জন্যও একসময় প্রচার চালিয়েছিলেন। যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন এবং তার জামিনের খরচ দিয়েছেন।

১৯৩৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নিজ দেশের সিডনিতে পড়াশোনা করা জন পিলজার কর্মজীবনে কাজ করেছেন ডেইলি টেলিগ্রাফ, রয়টার্স ও ডেইলি মিররসহ আরও অনেক জায়গায়। 

তিনি স্কার্থ ফ্লেট নামের এক সাংবাদিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা কম্বোডিয়ায় পোল পটের শাসনের পরবর্তী সময়কালকে কভার করার কাজের জন্যই মূলত পরিচিত ছিলেন। থ্যালিডোমাইড কেলেঙ্কারি এবং যুদ্ধকাহিনি লেখার পাশাপাশি তিনি তার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। নিজের কাজের ক্ষেত্রে তাকে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন হিসেবে অনেক দিন হতে মান্য করা হয়ে থাকে। সবশেষ রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জানানো হয় যে, ‘যদিও তার সাংবাদিকতা এবং প্রামাণ্যচিত্রগুলো সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল, কিন্তু তার পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন সবচেয়ে দুর্দান্ত মানুষ এবং সন্তানদের কাছে প্রিয় বাবা, নাতি-নাতনিদের কাছে প্রিয় দাদু এবং সঙ্গী। তিনি ও তার আত্মা শান্তিতে থাকুন।’ পিলজার ডেইলি মিরর, আইটিভির প্রাক্তন অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন এবং রয়টার্সের জন্য কাজ করেছেন।

১৯৭৯ সালে আইটিভির চলচ্চিত্র ইয়ার জিরো : দ্য সাইলেন্ট ডেথ অব কম্বোডিয়া খেমের রুজের অপরাধের মাত্রা উন্মোচন করে এবং পিলজার তার নব্বইয়ের দশকের অনুসরণকারী আইটিভির প্রামাণ্যচিত্র কম্বোডিয়া : দ্য বিট্রেয়ালের জন্য একটি ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব টেলিভিশন আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস পুরস্কার জিতেছিলেন। পিলজার ১৯৭৪ সালে আইটিভির জন্য থ্যালিডোমাইড : দ্য নাইনিটি-এইট উই ফরগোট, গর্ভবতী মায়েদের এই ওষুধ গ্রহণের পর জন্মগত ত্রুটির শঙ্কা উত্থাপনের পর শিশুদের ক্ষতিপূরণের জন্য চালিত আন্দোলন সম্পর্কে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে তিনি তথ্যগত রিপোর্টিংয়ের জন্য বাফটার রিচার্ড ডিম্বলেবাই পুরস্কার লাভ করেন।

চ্যানেল ফোর নিউজের সাবেক উপস্থাপক জন স্নো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন যে, ‘জন পিলজার ছিলেন একজন মহান এবং দৃঢ় সাংবাদিক। তাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতাম। ৮৪ বছর বয়সে তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমি দুঃখিত।’

আইটিভির মিডিয়া ও বিনোদন বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেভিন লাইগো মন্তব্য করেন যে, জন ছিলেন প্রচার সাংবাদিকতার জগতে একজন দানবস্বরূপ। তার একটি স্বচ্ছ, স্বতন্ত্র সম্পাদকীয় কণ্ঠ ছিল, যা তিনি তার বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাণ ক্যারিয়ারে চমৎকার প্রভাবের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তার প্রামাণ্যচিত্র ছিল আকর্ষণীয়, চ্যালেঞ্জিং এবং সর্বদাই দেখার মতো। তিনি আরামদায়ক সম্মতি এড়িয়ে গিয়ে বরং বর্তমান বিষয়ে একটি চরম, বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি এবং ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছেন। জন পিলজারের চলচ্চিত্র দর্শকদের এমন বিশ্লেষণ এবং মতামত দিয়েছে যা টেলিভিশন মূলধারায় প্রায়ই দেখা যায় না। এটি ছিল এমন একটি অবদান যা ব্রিটিশ টেলিভিশনের সমৃদ্ধ বহুত্বের সঙ্গে অনেক কিছু যোগ করেছে।

বিখ্যাত গানের দল পিংক ফ্লয়েডের সাবেক সদস্য সংগীতশিল্পী রজার ওয়াটারস, যিনি অ্যাসাঞ্জকেও সমর্থন করেছেন, পিলজারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ওয়াটারস নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে লিখেছেন যে, ‘জন পিলজার। আমি তোমাকে মনে করি ও আগামীতে মনে রাখব বন্ধু। আমি ভালো করে জানি যে তুমি কত মহান মানুষ ছিলে। ছিলে অসাধারণ সাহসী সাংবাদিক। আমরা তোমাকে চিরদিন আমাদের হৃদয়ে বহন করব, তুমি সবসময় শক্তি জুগিয়ে যাবে। তোমার বন্ধু রজারের পক্ষ থেকে ভালোবাসা রইল।’

এক্সে এক টুইটের মাধ্যমে উইকিলিকস পিলজারকে ‘শক্তিশালী সত্যবাদী, যিনি তার শেষ বছরগুলোতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি এবং পুনর্বাসনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন’ বলে অভিহিত করেছে। তারা আরও বলেছে, তার মৃত্যুতে আমাদের পৃথিবী আরও দুর্ভাগা হয়ে গেছে।

পিলজার তার কর্মজীবনে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বৈদেশিক নীতি এবং আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের প্রতি আচরণের সমালোচনা করে একগুচ্ছ মন্তব্য করেছিলেন। এ জন্য তার সময়ের তার বিরুদ্ধমতের অনেক রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাবানরা তাকে তেমন একটা পছন্দের নজরে দেখতেন বলে জানা যায় না। বরং তার প্রতি একটা বিরক্তি ও রাগ ভাব অনেকের মনের মধ্যে ছিল বলেই আমরা জানতে পারি। লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন তার এক্স অ্যাকাউন্টে একটি টুইটের মাধ্যমে লিখেছেন, ‘জন পিলজারের মৃত্যু শুনে আমি গভীরভাবে শোকাহত। জন অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চিলি, ইরাক, পূর্ব তিমুর, প্যালেস্টাইন এবং আরও অনেক অঞ্চলের অবহেলিত এবং দখলকৃত মানুষদের কণ্ঠস্বর দিয়েছেন। সত্যের অনুসরণে তোমার সাহসের জন্য ধন্যবাদ’- এটি কখনো ভোলা হবে না।

পিলজার রাশিয়া এবং এর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে বিতর্কিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন। ২০১৮ সালের একসময়ে পিলজার রাশিয়া টুডের (আরটি নামেও পরিচিত) সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে নিজের কথায় এমন মতামত প্রকাশ করেন যে, প্রাক্তন রাশিয়ান গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল, তার মেয়ে ইউলিয়া এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নিক বেইলির হত্যার চেষ্টা ছিল ‘যত্ন সহকারে তৈরি নাটক’। যুক্তরাজ্য সরকার এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বিশ্বাস করে যে, রাশিয়ান সামরিক গোয়েন্দা দলের সদস্যরা স্যালিসবারিতে এই হামলা চালিয়েছিল।

পিলজার রাশিয়া টুডে-কে বলেন, এটি একটি যত্ন সহকারে তৈরি নাটক, যা কয়েক বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য প্রচার অভিযানের অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। এটিই হলো চরম সত্য। ২০১৪ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় পিলজার বলেন, ‘একুশ শতকের ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের নিন্দা করার ক্ষেত্রে পুতিনই একমাত্র নেতা।’ গত বছর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সঙ্গে কথা বলার সময়, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিবেদনের প্রতি সন্দেহবাদী মনোভাব গ্রহণ করার আহ্বান করেন।

পিলজারের সাম্প্রতিক তথ্যচিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে আইটিভিতে প্রচারিত ‘দ্য ডার্টি ওয়ার অন দ্য এনএইচএস’ এবং ২০১৬ সালে একই চ্যানেলে প্রচারিত ‘দ্য কামিং ওয়ার অন চায়না’।

পিলজার খোলামেলা কথাবার্তা করতে পছন্দ করতেন। অনেক মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাজ তার পছন্দ না হওয়ায় এবং তাদের সঙ্গে মতের মিল না থাকায় সামনাসামনি তিনি তাদের সমালোচনা করতেন। ২০০২ সালে একবার তিনি বলেন যে, বেশিরভাগ সাংবাদিকরাই এখন আর সঠিক পথে নেই। তারা প্রকৃত সত্য বহন করে চলে না। ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাকে আক্রমণের বিরুদ্ধে গিয়েও তিনি অনেক মন্তব্য করেছিলেন।

জন পিলজার লন্ডনভিত্তিক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক। পিলজার ১৯৬২ সাল থেকে লন্ডনে বাস করছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিনিধি হিসেবে শুরু থেকেই তিনি মার্কিন, অস্ট্রেলীয় ও ব্রিটিশ বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর ছিলেন; যে বৈদেশিক নীতিকে তিনি সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের বলে বিবেচনা করতেন। পিলজার তার দেশের আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের ওপর আচরণের এবং প্রধান প্রচার মাধ্যমের প্রয়োগেরও সমালোচনা করতেন। ব্রিটিশ ছাপার প্রচার মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন ডেইলি মিরর পত্রিকায় এবং পাক্ষিক নিউ স্টেটসম্যান ম্যাগাজিনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পিলজার দুবার ব্রিটেনের সেরা সাংবাদিকের পুরস্কার পেয়েছেন। তার ডকুমেন্টারি, আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত, ব্রিটেন এবং সারা বিশ্বে পুরস্কৃত। এই সাংবাদিক অনেক সম্মানসূচক ডক্টরেট অর্জন করেছেন।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, সময়ের আলো

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close