ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতির সব ধরনের অধিকার আদায়ের আন্দোলন গতিশীল হয়েছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শক্তিই এনে দিয়েছে একাত্তরের স্বাধীনতা। এ কারণেই বাঙালি জাতির গৌরবময় স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সব দাফতরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশ ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান এসেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই ‘রাষ্ট্রভাষা’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর এতটাই মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল যে, পরবর্তীতে বাংলাকে সরকারি ভাষা বা দাফতরিক ভাষা করার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়ে পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা রাখেন সেখানে তিনি উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। মুসলিম লীগের অনেক সদস্য তখন বলতে চেয়েছিলেন, সরকারি বা দাফতরিক ভাষা মানেই রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে আমরা রাষ্ট্রভাষা বলতে সরকারি বা দাফতরিক ভাষা বুঝি না। তাই আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই চাই (সূত্র : স্বরোচিষ সরকার, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা)। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর এ পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। এতে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাভাষীদের গৌরব বেড়েছে। তারপরও বাংলা ভাষার স্বীকৃতির বিষয়টি আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক মনে করছি এই কারণে যে, আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি তাদের কাছে বাংলা ভাষা আজও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। একটি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য সে ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভাষিক সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি প্রয়োজন।
একটি ভাষার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা কতটুকু-তা বোঝার জন্য সে ভাষার ব্যবহারিক মূল্য নিরূপণ করে দেখা দরকার। সে দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথমেই বাংলা ভাষার ব্যবহারিক দিকটি পরখ করে দেখা যাক। যেকোনো ভাষা প্রয়োগ বা ব্যবহারের প্রধান মাধ্যম হলো মৌখিক বা মুখে বলে ভাষার প্রয়োগ করা। এ মাধ্যমে কোনো ভাষাগোষ্ঠীর সব মানুষই যুক্ত থাকে। আর একটি হলো লিখিত মাধ্যম। এ মাধ্যমে শুধু শিক্ষিত ব্যক্তিরাই যুক্ত থাকতে পারেন। বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন এবং বাংলা ভাষায় যারা লেখেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তাদের অধিকাংশই ভাষার শুদ্ধতার প্রতি মনোযোগী হন না। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। হয়তো তিনি শুদ্ধ রূপটি জানেন না কিংবা শুদ্ধরূপে বলা বা লেখার বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। যিনি জানেন না তার অপরাধ সামান্যই। কিন্তু যিনি জানেন কিন্তু গুরুত্ব দেন না তার অপরাধকে খাটো করে দেখা যায় না। কারণ তিনি জেনে-বুঝেই ভাষার মর্যাদাহানি করছেন। ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করছেন। বাংলা ভাষার মৌখিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অশুদ্ধ উচ্চারণ এখন এক ধরনের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যারা জানে তারাও শুদ্ধতাকে পরিহার করে চলে। সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিষয়টি মেনে নেওয়া গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া যায় না। বানানের ব্যাপারে সতর্ক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দফতরের চিঠিপত্রে ভুল বানান নির্দেশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে থাকেন। সেখানে অনাকাক্সিক্ষত বানান ভুলের ছড়াছড়ি দেখে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভাষাজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। অনেকে বলবেন, অভ্যাসের কারণে এমনটি হয়ে থাকে। স্বীকার করি। কিন্তু অভ্যাস পরিবর্তনের প্রচেষ্টাও তো থাকতে হবে। প্রায় দুই যুগ ধরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে পড়াতে হয়েছে। কর্মজীবনে তাদের অনেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু মুখের ভাষায় শুদ্ধতা অর্জন করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে জ্ঞান নয়, সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করা চলে। মাতৃভাষার শুদ্ধতা অর্জনের ক্ষেত্রে এমন অবহেলা কাম্য নয়।
বাংলা লেখার ক্ষেত্রেও বাঙালিদের মধ্যে নৈরাজ্যের সীমা নেই। এ ক্ষেত্রে বানান ভুলের ব্যাপারটি বিবেচনায় আনা হলে হতাশ না হয়ে পারা যায় না। অফিস-আদালতে, পত্র-পত্রিকায়, বিলবোর্ড-বিজ্ঞাপন প্রচারের নানা সাইনবোর্ডে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামফলকে বানান ভুলের ছড়াছড়ি দেখে মনে হয় বাংলা ভাষার শুদ্ধতা বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। কেউ বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছে না। অথচ এই বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে বাঙালি জাতি। আমার দেশের ছেলেরা বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্ত দিয়েছে অকাতরে। তার পরেই না ভাষা আন্দোলনে বিজয় অর্জিত হয়েছে। আমরা পেয়েছি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। বাংলা ভাষা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা জাতীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জাতীয় ভাষা বাংলার মর্যাদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাকে যারা শ্রদ্ধা করেন, যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন তারা কোনোভাবেই বাংলা ভাষার প্রতি এ ধরনের অবহেলা সহ্য করতে পারেন না। ব্যবহারিক মর্যাদা না দেওয়া স্বীকৃতি না দেওয়ার শামিল। স্বীকৃতির মাধ্যমে একটি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি প্রয়োজন। ভাষার স্বীকৃতির মানে ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা মেনে নেওয়া। এই মেনে নেওয়াটা হতে হয় মনোজাগতিক দিক থেকে। কোনো লোকদেখানো স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষাকে প্রকৃত মর্যাদায় অভিষিক্ত করা যায় না।
বর্তমানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি বিষয়ে এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক মনে করার আরও একটি প্রধান কারণ হলো ভাষা আন্দোলনের সাত দশক এবং স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে দেখা যাচ্ছে না। ভাষা শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষার প্রেমিক হয়ে ওঠা কিংবা লোকদেখানো বাঙালি হয়ে ওঠা আর বাকি সময় বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করার মানে হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার মর্মমূলে আঘাত করা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাজ্ঞজন যারা আছেন এ ব্যাপারে তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা দরকার। দেশের সব অফিস-আদালতে, পত্র-পত্রিকায়, বিলবোর্ড-বিজ্ঞাপন প্রচারের সাইনবোর্ডে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামফলকে, পরিবহনে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে বানানের শুদ্ধতা রক্ষা করার দাবিতে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এমনকি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। অধ্যাপক ড. স্বরোচিষ সরকার ঢাকার কোনো এক হোটেলে খাবার খেতে গিয়ে হোটেলের নামফলকে ভুল বানান দেখে ফিরে এসেছিলেন। বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্ববহ না হলেও যারা ভাষাপ্রেমী তাদের জন্য এটি একটি মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে। ভুল বানানকে এভাবেই প্রত্যাখ্যান করা উচিত। তা হলে সবাই সতর্ক হবেন।
আমরা প্রায় ২০০ বছর সংগ্রাম করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেছি। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ রক্ত দিয়েছে। অনেকেই হয়তো যুক্তি দেবেন যে, আন্তর্জাতিক মানের কারণে ইংরেজির মর্যাদা বেশি। আমি নিজেও ইংরেজি ভাষাবিদ্বেষী নই। বৈশ্বিক প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে বাংলার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকতে হবে। বিদেশি ভাষা আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা আমাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। একটি প্রয়োজন আর একটি আত্মপরিচয়। প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে আত্মপরিচয়কে অবহেলা করলে কোনো জাতি মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। চীন, জাপান, কোরিয়াসহ অনেক দেশ নিজস্ব ভাষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। তাই বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারা পিছিয়ে নেই।
বাংলা ভাষার সামাজিক স্বীকৃতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বীকৃতির কথাও ভাবতে হবে। বাংলা ভাষায় যারা পারদর্শী কিংবা বাংলা ভাষায় যারা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যেসব ক্ষেত্রে ইংরেজি বা বিদেশি ভাষা জানার প্রয়োজন নেই সেখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমের গ্র্যাজুয়েটদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কর্মক্ষেত্রে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করতে হবে যে, বাংলায় পড়ে কিংবা বাংলা মাধ্যমে পড়ে ভালো চাকরি পাওয়া যায়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে এখনও বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। নিজ দেশেই যদি জাতীয় ভাষার অর্থনৈতিক গুরুত্ব না থাকে তা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা কীভাবে আমাদের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করব? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষায় গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো গবেষণা হলে সেটির ‘টার্গেট পিপল’ বাংলাদেশের মানুষ। বাংলায় গবেষণা হলে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী সে গবেষণার ফলাফল জানতে পারবে। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুযারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপিত হলেই বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বাংলা ভাষার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সময়ের আলো/আরএস/