ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ক্ষমা প্রদর্শন, অতঃপর পদত্যাগ
প্রকাশ: সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:৪২ এএম  (ভিজিট : ৪৪২)
শিশুদের নিগ্রহকারীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে জনরোষের মুখে পড়েছিলেন হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট। ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করলেন তিনি। এক ধারাবাহিক শিশু নিগ্রহকারীকে ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন ক্যাটালিন। দেশের মানুষ প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তাই তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল মধ্য ইউরোপের দেশটিতে।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষমা প্রদর্শন করে অপরাধীর সাজা লাঘব করেছিলেন ক্যাটালিন। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শিশু নিগ্রহের অভিযোগ প্রমাণিত। সরকারচালিত একটি হোমে তিনি শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতেন। গোপনে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছিলেন তিনি। পরে ধরা পড়েন এবং আদালত তার শাস্তির নির্দেশ দেন। আট বছরের সাজা হয়েছিল ওই অপরাধীর। ক্যাটালিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে তা কমিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রচারমাধ্যমগুলোতে এসেছে, শিশু যৌননিপীড়নের একটি ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হয়ে দণ্ড পাওয়া এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়ার কেলেঙ্কারির দায় মাথা নিয়ে পদত্যাগ করেছেন হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ক্যাটালিন নোভাক। টেলিভিশনে সরাসরি ভাষণ দিতে এসে ক্যাটালিন নোভাক নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দেন। নিজের ভুলের কথা স্বীকার করে ৪৬ বছর বয়সি নোভাক বলেন, ‘আমি আমার পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি।’

গত সপ্তাহে ক্যাটালিন নোভাকের বিরুদ্ধে একটি খবর প্রকাশ পায়। যেখানে বলা হয়, তিনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেছেন যিনি রাষ্ট্র পরিচালিত একটি শিশুসদনের একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠা শিশু যৌননিপীড়নের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে শিশুদের বাধ্য করেছিলেন।

এ খবর প্রকাশের পরপর ক্যাটালিন নোভাকের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয় এবং বিক্ষোভকারীরা তার পদত্যাগ দাবি করেন। নিজের এ কাণ্ডের জন্য নোভাক ক্ষমা চেয়েছেন এবং বলেছেন, এই ক্ষমা প্রদান করে তিনি ‘ভুল’ করেছেন। সাবেক বিচারমন্ত্রী জুডিথ ভার্গা, যিনি ওই ক্ষমার আবেদনে অনুমোদন দিয়েছিলেন, তিনিও তার বর্তমান দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

গত বছর এপ্রিলে ক্যাথেলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের হাঙ্গেরি ভ্রমণ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট নোভাক ২৫ কারাবন্দিকে সাধারণ ক্ষমা করেন। গত  সপ্তাহে ক্ষমা পাওয়া ওই ২৫ কারাবন্দির নাম স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

ওই তালিকায় রাজধানী বুদাপেস্টের কাছে একটি শিশুসদনের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত উপ-পরিচালকের নামও দেখা যায়। ওই শিশুসদনের পরিচালকের বিরুদ্ধে শিশুদের যৌননিপীড়নের অভিযোগ উঠলে উপ-পরিচালক অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে শিশুদের বাধ্য করেছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয় এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠা পরিচালকও দোষীসাব্যস্ত হন এবং তার আট বছরের কারাদণ্ডের সাজা হয়।

এমন একজনকে ক্ষমা করে দেওয়ায় নোভাকের পদত্যাগের দাবিতে হাঙ্গেরিজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিরোধী দলগুলো সে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি শুরু করে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র নোভাক। ক্যাটালিন প্রথম নারী, যিনি হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। যদিও দেশটির প্রেসিডেন্ট পদটি মূলত আলংকারিক। হাঙ্গেরির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২২ সালে শপথ নিয়েছিলেন ক্যাটালিন। তার আগে তিনি শাসকদল ফিডেসের মন্ত্রী ছিলেন। ওই দল ২০১০ সাল থেকে হাঙ্গেরির ক্ষমতায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হাঙ্গেরির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ক্যাটালিন। তার সিদ্ধান্তে শাসকদলও অস্বস্তিতে পড়েছিল। দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চেয়ে। জনগণের দাবি মেনে নিয়ে পদ ছেড়েছেন ক্যাটালিন। নোভাক এর আগে পারিবারিক নীতিবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। টেলিভিশনে তিনি বলেন, ‘যাদের কষ্ট দিয়েছি এবং যেসব ভুক্তভোগীর মনে হয়েছে যে আমি তাদের সমর্থন করিনি, আমি তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শিশুদের ও তাদের পরিবারের সুরক্ষায় আমি আছি, আমি ছিলাম এবং আমি থাকব।’

এ ঘটনা হাঙ্গেরির দীর্ঘদিনের জাতীয়তাবাদী সরকারের জন্য একটি নজিরবিহীন রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, এটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য গভীর বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে পারিবারিক মূল্যবোধকে তার সামাজিক নীতির ভিত্তি করে তুলেছে।

নোভাক ১৯৭৭ সালে দক্ষিণ হাঙ্গেরির সেজেগেডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিক সায়েন্সেস অ্যান্ড পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ২০১১ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সেজেড ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি প্যারিস এক্স থেকে কমিউনিটি এবং ফরাসি আইনে ডিগ্রি অর্জনের আগে নোভাক ২০০১ সালের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে তার সন্তানদের জন্মের পর ২০১০ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানোস মার্টোনির উপদেষ্টা ছিলেন। 

২০১২ সালে তিনি ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবার ও যুববিষয়ক রাষ্ট্রীয় সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আগে তৎকালীন মানবসম্পদ মন্ত্রী জোল্টান বালোগের মন্ত্রিপরিষদ প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি ২০২০ সালে পারিবারিক বিষয়ক পোর্টফোলিওবিহীন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ঘোষণা করেছিলেন যে, ক্ষমতাসীন ফিদেজ নোভাককে প্রজাতন্ত্রের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করবেন। নোভাক জানুয়ারিতে ঘোষণা করেছিলেন তিনি ফিদেজে তার সদস্যপদ স্থগিত করছেন। নোভাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতে বসবাস করেছেন এবং কাজ করেছেন। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন তিনি। হাঙ্গেরির সংবিধান অনুসারে, প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জাতির ঐক্যকে মূর্ত করেন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ নিরীক্ষণ করেন এবং হাঙ্গেরির সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কাজ করেন। 

প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য সংসদ দ্বারা নির্বাচিত হন এবং সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। হাঙ্গেরির প্রথম রাজা সেন্ট স্টিফেনের সময় থেকেই হাঙ্গেরিয়ানরা পশ্চিমের অন্তর্ভুক্ত হতে চান-সে বিষয়ে সামাজিক ঐকমত্য রয়েছে, তিনি যোগ করেন। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ হাঙ্গেরির আর্থিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা এবং ন্যাটো সদস্যপদ নিরাপত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। 
২০১৮ সালে ওই অপরাধীকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। শিশুসদনটির উপ-পরিচালক ছিলেন তিনি। অভিযোগ, নিজের ‘বসে’র অপরাধ ঢাকতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। নিগৃহীত শিশুদের ওপর মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দেওয়ার কথাও জানা গেছে। এ ধরনের অপরাধীকে ক্ষমা করেছেন প্রেসিডেন্ট-এই খবর সামনে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ। শেষপর্যন্ত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরেও বিক্ষোভ করেন প্রতিবাদীকারীরা। যদিও গত বছরের এপ্রিলে ওই অপরাধীকে ক্ষমা করা হয় বলে জানা গেছে।

হাঙ্গেরিতে অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে প্রেসিডেন্টের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নামতে হয়েছে অরবানকে। সে দেশের সংবিধানে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে, যেখানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকারকে খর্ব করার কথা বলা হয়েছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close