যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে সকাল ৮টায়ও জ্বলছিল হরেক রকমের লাইট। চারদিক সরগরম পাইকারি বিক্রেতাদের হাঁকডাকে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে আড়তে পাড়া-মহল্লায় মাছ ফেরি করে বিক্রি করেন এমন বিক্রেতাদের উপস্থিতিই বেশি। অনেকে এসেছেন পরিবার বা হোটেল-রেস্টুরেন্টের জন্য বেশি পরিমাণে মাছ কিনতে। কিছুটা সাশ্রয়ী দামে কেনার আশায় সকালে ঘুম থেকে উঠে এসেছেন তারা। বেলা বাড়লে বিক্রেতাদের শোরগোলের মধ্যে চোখ পড়ে মূল রাস্তার পাশের একটি গামলায়। অনেকগুলো মাছের মাথা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৬-১৭ বছরের এক কিশোর। কাছে গিয়ে দেখা গেল গামলাভর্তি পাঙাশ মাছের কাটা মাথা। এসব মাছে মাথা ও লেজের অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই।
কাটাগুলো থেকে লাল রক্ত ঝরছিল, যা অনেকটা ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। নিম্ন আয়ের বেশ কয়জন নারী সেখান থেকে ৫টি-১০টি করে মাথা কিনে নেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে গেলে ওই কিশোর গামলাটি নিয়ে আবার ভেতরে চলে যায়। প্রায় মিনিট দশেক পর আবার গামলাভর্তি করে হাজির হয় একই জায়গায়। আগের মতোই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল সবগুলো পাঙাশের মাথা।
যাত্রাবাড়ী আড়তে কথা হয় বেশ কয়েকজন মাছ বিক্রেতার সঙ্গে। তারা জানান, রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টের জন্য কেনা হয়েছিল এসব পাঙাশ মাছ। মাছের মূল অংশ নিয়ে যাওয়ার পর মাথাগুলো ফেলে যান তারা। আর সেই ফেলে দেওয়া মাথা সংগ্রহ করা হয়।
বেশ কয়েকজন মাছ বিক্রেতা জানান, ঢাকার বহু রেস্টুরেন্ট ও চাইনিজে সামুদ্রিক ফিশ ফ্লাই, ফিশ বার্গার, ফিশ বল ও ভর্তাসহ মাছের নানা পদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এসব পাঙাশ। সামুদ্রিক আইড় বা বড় মাছের কথা বলে এগুলো চালিয়ে দেওয়া হয়। ক্রেতারাও না বুঝে কম দামের ফিশ আইটেম বেশি দামে খেয়ে ঠকেন।
যাত্রাবাড়ী আড়তে কয়েক দিন লুঙ্গি ও সাধারণ পোশাক পরে পর্যবেক্ষণ করে পাঙাশ মাছ নিয়ে এমন জালিয়াতির ঘটনার সত্যতা মিলেছে। শুধু যাত্রাবাড়ীই নয়, কারওয়ান বাজারেও দেখা গেছে একই অবস্থা। মূলত এক শ্রেণির হোটেল ও চাইনিজ রেস্টুরেন্ট মালিক সস্তার পাঙাশ কিনে দামি ফিশ আইটেমের নামে সেসব বিক্রি করে দীর্ঘদিন ধরে ভোক্তাদের ঠকিয়ে আসছেন।
মাছের কাটা মাথা বিক্রি করা কয়েকজন জানান, কয়েক মাস আগেও এসব মাথা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হতো বা বিড়ালের জন্য বিনা পয়সায় চেয়ে নিতেন গৃহস্থরা। এখন সেসব মাথা অনেকটা দাম দিয়েই কিনে নেন নিম্ন আয়ের মানুষজন। ছোট-বড় আকার অনুযায়ী প্রতিটি মাথা বিক্রি হয় ১৫ থেকে ৩০ টাকায়। শাক, ডাল বা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে এগুলো রান্না করে খান তারা। মাথা কিনতে আসা বেশ কয়েকজন নারীও একই তথ্য জানান।
গত কয়েক দিন যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে মাছ ক্রেতা সেজে সস্তার পাঙাশের দামি মাছে রূপান্তরের চিত্রটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় দেখা যায়, শুধু পাঙাশ মাছই নয়, এক শ্রেণির রেস্টুরেন্ট ও চাইনিজ মালিক গলদা ও বাগদার পরিবর্তে কিনে নেন সস্তা দামের চিংড়িও। গলদা ও বাগদা চিংড়ির বিভিন্ন পদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয় এসব কম দামি চিংড়ি।
যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে ৫০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয় ঘেঁষে ভেতরে গেলে চোখে পড়বে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। এর পাশেই এক কোনে চারদিকে টিন দিয়ে ঘেরা একটি ছোট কক্ষে চলে মাছ কাটার কর্মযজ্ঞ। দেয়ালে টানানো একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ’। ভেতরে উঁকি দিতেই দেখা যায়, বেশ কয়েকজন কিশোর-তরুণ গোল হয়ে বসে আছে। ধারাল ছুরি দিয়ে কেউ পাঙাশ মাছ কেটে আলাদা করছেন। আবার কেউ চিংড়ির মাথা ও খোসা ছাড়াচ্ছেন। রুমের ভেতরে দেখা গেল বেশ কয়েকটি পাত্রে বিভিন্ন ধরনের মাছ। একটি বড় ফ্রিজও আছে। বিভিন্ন হোটেল ও চাইনিজের জন্য অর্ডার করা হয়েছে এসব মাছ। সেগুলোর প্রসেস করছেন তারা।
সালেহ নামের এক কর্মী সময়ের আলোকে জানান, তারা বিভিন্ন হোটেল ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টের জন্য বিভিন্ন পদের মাছের অর্ডার নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে পাঙাশ মাছ ও চিংড়িই বেশি।
এই কর্মী জানান, তারা মূলত মাছ কেটে মূল অংশ আলাদা করে বিক্রি করেন। প্রতিদিন দেড়শত থেকে ২০০ কেজি পাঙাশ, ৩০-৫০ কেজির মতো চিংড়ি প্রসেস করে থাকেন তারা। কোনো কোনোদিন পরিমাণে কম-বেশি হয়ে থাকে। মাছের মূল অংশ অর্ডারকারীরা নিয়ে যান আর মাথা বাইরে কম টাকায় বিক্রি করেন, যা নিম্ন আয়ের মানুষ কিনে নিয়ে যায়।
আবু হেনা নামের এক কর্মী জানান, বড় বড় চাইনিজগুলো বা অনেক দামি রেস্টুরেন্টে বিদেশিদের জন্য ফিশ ফ্রাই, স্যুপ, ফিশ বল, ফিশ বার্গার এবং ভর্তাসহ নানাপদ তৈরির জন্য পাঙাশ মাছ কিনে থাকে। মাথাসহ ১২০ টাকা থেকে দেড়শত টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাথা ও কাটা ছাড়িয়ে মূল অংশ ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে তারা।
আরেক কর্মী রুহুল জানান, বড় মাছ বা সামুদ্রিক মাছের ফ্রাইতে এগুলো ব্যবহার করা হয়। মাছ তেলে ভাজার পর কিংবা কোনো কিছু তৈরির পর তো আর বোঝা যায় না এগুলো পাঙাশ না অন্য কোনো দামি সামুদ্রিক মাছ। সবাই পুষ্টিগুণসম্পন্ন সামুদ্রিক মাছ মনে করেই পাঙাশ দিয়ে বানানো নানা বাহারি নামের ‘দামি ফিশ আইটেম’ খেয়ে থাকেন।
যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের এক আড়তদার নাম প্রকাশ না করে বলেন, এটা এক ধরনের প্রতারণা। এক শ্রেণির হোটেল- রেস্টুরেন্ট মালিক বড় ও সামুদ্রিক মাছের বদলে কম দামি মাছ খাইয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। বিষয়টি অনেকে জানলেও আড়তদার বা পাইকারি বিক্রেতাদের স্বার্থ না থাকায় কেউ মাথা ঘামান না।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, পাঙাশ মাছকে দামি মাছ হিসেবে বিক্রির কথা এবারই প্রথম শুনেছি। এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেননি। তবে কেউ অভিযোগ করলে বা প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সময়ের আলো/আরএস/