বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা সমালোচনা পর্যালোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষার মান উন্নয়নের সঠিক কোনো পথ এখন পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরও পাওয়া যায়নি সময়োপযোগী শিক্ষানীতি। সরকার যাচ্ছে সরকার আসছে কিন্তু শিক্ষানীতির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম। মাঝেমধ্যে মনে হয় পণ্ডিত মশাই যখন বটগাছের নিচে বসে পাঠদান করতেন, তখনই ছিল প্রকৃত শিক্ষা। মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ততই বিল্ডিং এসি রুম সাজানো গোছানো শ্রেণিকক্ষ-এসবের মাঝে আটকে যাচ্ছে শিক্ষা। জীবনমুখী শিক্ষার বড় ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণের যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবাই আছে আলোচনা সমালোচনায় ব্যস্ত।
শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সরকারি খরচে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করছেন, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেখছেন কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনোটাই কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। মাঝখান থেকে গচ্চা যাচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
বাংলাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা-এই চার ধরনের শিক্ষাক্রম চালু আছে। একেবারেই শিশুদের জন্য আছে কেজি বা কিন্ডারগার্টেন বা শিশুবাগ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে শিশুদের খেলতে খেলতে নানান কিছু শেখানো হয়। মানবজীবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ আ ক খ থেকে পড়া এবং লেখা সবই শেখানো হয়। তারপর শিক্ষার ব্যাপারটা পুরোটাই নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের ওপর। যে পড়ালেখায় যত বেশি মনোযোগী সে তত বেশি সফলতা পায়।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নে তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেই যা দিয়ে তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। সময়োপযোগী শিক্ষা বলে যে শব্দটা আজকাল অনেক বেশি শোনা যায়, তারও কোনো বালাই নেই বাংলাদেশে। অথচ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ টাকা খরচ করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে যে লাউ সেই কদু। একজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে যেমন ছিলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও তেমনি আছেন। এর অর্থ হলো, কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা কোনো কাজে লাগেনি। এভাবে প্রশিক্ষণের নামে প্রচুর টাকা জলে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আসলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলাম সম্পর্কে এদেশের অধিকাংশ শিক্ষকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। তারা ভাসাভাসা জানেন। কী করতে হবে ঠিক পুরোটা জানেন না। কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতে হবে তাও শিক্ষকদের কাছে স্পষ্ট নয়। যে মানুষ নিজেই জানেন না, তিনি অন্যকে জানাবেন কীভাবে? এমন একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। সে প্রশ্নটা নিয়ে কতদূর সামনে আগানো যাবে?
শিক্ষার মানের সঙ্গে শিক্ষাক্রমের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। শিক্ষাক্রম আসলে কী তা যদি একজন শিক্ষক না জানেন, তাহলে তিনি মানসম্মত শিক্ষাদান করবেন কীভাবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বর্তমান কারিকুলাম আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত চলমান শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি সংশোধন, আন্তর্জাতিক মান ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে এ পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বর্তমান শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকছে না কোনো বিভাগ বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি বিষয়। দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপরই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভাগ পছন্দ করতে হবে। একাদশ শ্রেণি শেষে পরীক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসির ফলাফল।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বই। তবে সব শ্রেণিতেই শিখনকালীন মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা থাকছে না।
২০২২ সালে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির ও মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণির পাইলটিং শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০২৪ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ শিক্ষাক্রম অনুমোদন করেছেন।
অনেক গবেষণা করে বাংলাদেশে একটা শিক্ষাক্রম দাঁড় করানো হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পেছনের এবং বর্তমানের কোনো শিক্ষাক্রম সম্পর্কেই বেশিরভাগ শিক্ষকের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। ধারণা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। সরকার আসছে সরকার যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষাক্রমের ধারণাটা পরিষ্কার করার জন্য কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। এর জন্য কী করতে হবে তাও ভাবছেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দেশের শিক্ষাক্রম সম্পর্কে অতটা ওয়াকিবহাল নয়। তাদের অধিকাংশই আসলে জানে না কী পড়ানো হচ্ছে সন্তানদের। স্কুলশিক্ষক যা বোঝান তা-ই তারা বুঝে নেন। প্রশ্ন করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচক্ষণতা গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ অভিভাবকের নেই। যার ফলে বর্তমান শিক্ষাক্রমের সুবিধা-অসুবিধা কোনোটাই তারা জানেন না, বোঝেন না।
একজন মানুষ উচ্চশিক্ষা লাভ করাই যে শিক্ষিত হওয়া নয় তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। আছে নানা মুনির নানা মত। আমাদের দেশের শিক্ষার যে মান তা থেকে বলা যায় উচ্চশিক্ষা লাভ করা মানেই শিক্ষিত হওয়া নয়। শিক্ষিত হওয়ার জন্য গবেষণার প্রয়োজন আছে। পড়ালেখার দরকার আছে। শুধু পরীক্ষা পাস করে সার্টিফিকেট অর্জন মানে উচ্চ শিক্ষিত নয়। সার্টিফিকেটের পাশাপাশি জ্ঞানার্জনও জরুরি।
বাংলাদেশে জ্ঞানার্জনের বিষয়টা বরাবরই উপেক্ষিত। পড়ালেখা শেষ করে বড় সরকারি/বেসরকারি চাকরি পাওয়া যে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মূল লক্ষ্য, সে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া কয়দিন পরপর শিক্ষাব্যবস্থায় আনা হয় পরিবর্তন। একবার পরীক্ষা পদ্ধতি রাখার কথা বলা হয়। পরক্ষণেই বলা হয় পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথা।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। তাদের কোনো টেনশন নেই, দৌড়ঝাঁপ নেই। অভিভাবকরাও নিশ্চিন্ত। কারো মাঝে কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। থাকবে না কোনো ইঁদুর দৌড়।
এই কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ কম থাকবে। তবে একটা আশঙ্কা থেকে যায় যে এমনিতেই ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে চায় না। শিশুবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে না পারলে ভবিষ্যতে কী হবে। তারা কি বই পড়া ও লেখার দিকে মনোযোগ দিতে পারবে? পরীক্ষার জন্য হলেও তারা যে রাত জেগে পড়ালেখা করে, শিশু শিক্ষার্থীর সে অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে যায় কি না। বিষয়টা আসলেই ভাবনার।
শিক্ষকরা আশঙ্কা করছেন কারিকুলামে পরীক্ষা না থাকলে তাদের ব্যাচ বা টিউশন বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আয় অনেক কমে যাবে। কারিকুলামে একটা স্থিতিশীলতা অবশ্যই দরকার। আমাদের দেশে অনেক অভাব-অনটন আছে। তার মাঝে একটা বড় অভাব হলো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব। এই অভাবটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। তাদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষায় মানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকতায় আসতে চায় না। তাদের এই না চাওয়ার ফলে কম মেধাবী বা মেধাহীন অনেকেই শিক্ষকতার স্থানটি দখল করে নিচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার মানের ওপর।
মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের ঘাটতির কারণে সবখানেই একটা নিম্নমান বিরাজমান। একজন ভালো ছাত্র গড়ে তোলার পেছনে একজন মেধাবী দক্ষ শিক্ষকের অবদান সবচেয়ে বেশি। যিনি ছাত্রছাত্রীকে গড়ে তুলবেন, তিনি অবশ্যই মেধাবী শিক্ষিত ও দক্ষ হবেন।
শিক্ষকতা পেশার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। এই কারিগরদের হাতেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। বিষয়টা মাথায় রেখে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারণ করতে হবে। সামাজিক-পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অবস্থানের বিচারে নির্ধারণ হওয়া উচিত একটি দেশের শিক্ষা কারিকুলাম।
সাংবাদিক ও লেখক
সময়ের আলো/আরএস/