ঈদের আগে বেতন-বোনাস ইস্যু ঘিরে উৎকণ্ঠা বাড়ছে তৈরি পোশাক খাতে। ঈদ ঘনিয়ে এলেও এখনও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনই দিতে পারেননি ৫০-৬০টি কারখানার মালিক। গাজীপুরের কেয়া স্পিনিং মিলের ৮ হাজার শ্রমিকের দুই মাসের বেতন, বোনাস ও আর্নলিভের টাকা দেয়নি কেয়া স্পিনিং মিল কর্তৃপক্ষ। এ কারণে গত তিন দিন ধরে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা।
এ ছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুর, টঙ্গী বিসিক, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকার ৭-৮টি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা মঙ্গলবার বিক্ষোভ করেছেন বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে। এর বাইরে ঢাকার মিরপুর, সাভার, আশুলিয়া এবং নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু কারখানায়ও বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। এভাবে বেতন-বোনাসের দাবিতে ঈদের আগে অসন্তোষ বাড়ছে পোশাক শিল্পে।
এই পরিস্থিতিতে ঈদের আগে বেতন-বোনাস ইস্যুকে ঘিরে পোশাক শিল্পে অসন্তোষ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে খোদ শিল্প পুলিশ। এই ইস্যুকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে তার জন্য শিল্প পুলিশ থেকে শুরু করে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে শিল্প মালিক ও মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং যেসব কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর দ্রুত সমাধানের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
এমন তথ্য জানিয়ে শিল্প পুলিশের গাজীপুর অঞ্চল প্রধান মোহাম্মদ সরওয়ার আলম মঙ্গলবার সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমার গাজীপুর অঞ্চলে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩০০টি শিল্প কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে ১ হাজার ১৮৫টির মতো। ঈদের আগে প্রায় সব কারখানাতেই কোথাও বেতন নিয়ে সমস্যা, কোথাও বোনাস নিয়ে সমস্যা, কোথাও ছুটির সমস্যা-এভাবে প্রতিটি কারখানাতেই কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে। আবার অনেক কারখানার মালিক ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে গড়িমসি করছেন। কোনো কারখানা মালিক বলছেন, শুধু বোনাস দিতে পারবেন, আবার কেউ বলছেন, শুধু বেতন দেবেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে নির্দেশ রয়েছে-ঈদের আগে সব কারখানাতে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন, ঈদ বোনাস, আর মার্চ মাসের বেতন পুরো না হলেও যেন ১৫ দিনের দেওয়া হয়। আমরাও শিল্প মালিকদের সেভাবেই পরিশোধের আহ্বান জানাচ্ছি, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-অনেক শিল্প মালিকই বেতন-বোনাস দিতে গড়িমসি করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাজীপুর মহানগরীর জরুন এলাকায় কেয়া স্পিনিং মিলের প্রায় ৮ হাজার শ্রমিককে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বেতন, ঈদ বোনাস ও অর্জিত ছুটির অর্থ দেয়নি মালিকপক্ষ।
স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসে গত দুদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। আজ (মঙ্গলবার) দিনভর আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আগে বোনাস ও অর্জিত ছুটির অর্থ দেওয়া হবে এবং ঈদের ছুটির আগে অন্তত এক মাসের বেতন দেওয়া হবে। শ্রমিকরা এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেন। কিন্তু তারা আবার সন্ধ্যার পর রাস্তায় নেমে আগের মতো দুই মাসের বেতনসহ সব পাওনা দাবি করছেন। এ জন্য কারখানাটির সংকট মেটানো যায়নি। তবে আমরা মালিকদের বলেছি, শ্রমিকরা কাজ করেছে তাদের সব পাওনা দিতে হবে।’
এদিকে বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে মঙ্গলবার নতুন করে আরও ৭-৮টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ ফেলে বিক্ষোভ করেন বলে শিল্প পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। গাজীপুরের শ্রীপুর, কোনাবাড়ী, টঙ্গী বিসিক, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর এলাকার এসব কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভেতরেই বিক্ষোভ করেন। হয়তো যেকোনো সময় তারাও রাস্তায় নেমে আসতে পারেন বলে আশঙ্কা শিল্প পুলিশের।
এদিকে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ নেতা ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদ একেবারে ঘনিয়ে এলেও এখনও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন হয়নি ৫০-৬০ কারখানায়। মঙ্গলবার পর্যন্ত বোনাস হয়নি ৯০ ভাগ কারখানায়। আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যেই অধিকাংশ কারখানায় বোনাস দেওয়া হবে। আর মার্চের বেতন দেওয়া হবে ঈদের একেবারে আগমুহূর্তে, ৭ ও ৮ মার্চের দিকে। আবার কোনো কারখানা মালিক বেতন দেবেন একেবারে শেষ দিন ৯ মার্চ, যখন অনেক শ্রমিক ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবেন। বড় কারখানার শ্রমিকরা মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস পেলেও ছোট-মাঝারি কারখানায় শ্রমিকদের বোনাস দেওয়া হয় মালিকের মর্জিমাফিক। এ ছাড়া ছোট-মাঝারি কারখানাতেই বেতন-বোনাস নিয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে এখন।
বেতন ও বোনাস দেওয়া নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্রতি বছরই ঈদের আগে গার্মেন্ট খাতে বেতন-বোনাস নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। বড় বড় কারখানার মালিক আগে আগে বেতন-বোনাস দিতে পারলেও অধিকাংশ কারখানার মালিক বেতন-বোনাস দেন শ্রমিকরা বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠার পর, এটি তো ঠিক না। আমি যতটা জানি এখনও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনই দেননি ৫০-৬০টি গার্মেন্টস কারখানা মালিক। মার্চ মাসের বেতন এখনও দেওয়াই শুরু করেননি শিল্প মালিকরা। এখনও ৯০ শতাংশ কারখানায় বোনাস দেওয়া হয়নি। হয়তো আজকালের মধ্যে বোনাস দেওয়া হয়ে যাবে। আর মার্চ মাসের বেতন দেওয়া হবে একেবারে শেষ মুহূর্তে। এভাবে যদি একেবারে শেষে বেতন-বোনাস দেওয়া হয় তা হলে শ্রমিকরা সন্তান-পরিবার-পরিজনের জন্য কেনাকাটা করবেন কখন, আর বাড়িই বা যাবেন কখন। আসলে মালিকরা কাজ ঠিকই উঠিয়ে নেন শ্রমিকদের দিয়ে, সময়মতো ঠিকই শিপমেন্ট হচ্ছে, কিন্তু বেতন-বোনাস দেওয়ার বেলায় তারা গড়িমসি করেন-এটি তো অন্যায়।’
এদিকে শিল্প মালিকরা বলছেন, নানা কারণে ব্যবসা ভালো নেই। অনেক কারখানায় কাজ নেই। এ জন্য বেশ কিছু কারখানা মালিক অর্থ সংকটে আছে, বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, অর্থ জোগানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমন তথ্য জানিয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, ‘গার্মেন্টস মালিকরা ভালো নেই। অনেক কারখানাতেই কাজ নেই। উল্টো দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সব ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটও রয়েছে প্রকট। সব মিলিয়ে সংকটে আছেন অনেক শিল্প মালিক। তবে শ্রমিকরা যেহেতু কাজ করেছেন, তাদের বেতন-বোনাস দিতেই হবে। মালিকরা চেষ্টা করছেন ঋণ করে হলেও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে।’
সময়ের আলো/আরএস/