খেলাধুলা ও শরীরচর্চা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর চিন্তার সৃজনশীল বিকাশ ঘটে, নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জিত হয়, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার সাহস বাড়ে, দেশপ্রেম জাগ্রত হয় এবং নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটে। শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমে যায়। আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখতে পাই, শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ খুব কম মানুষ আছেন যারা অপরাধ, অনৈতিক কাজ ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।
আজ দেশে যে কিশোর গ্যাং কালচার শুরু হয়েছে, তা রোধ করতে পর্যাপ্ত খেলাধুলার বিকল্প নেই। খেলাধুলা যে শুধু শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে তা-ই নয়, একজন খেলোয়াড় শুধু নিজের জন্য নয় বরং নিজের দেশ ও জাতির জন্যও সম্মান ও পরিচিতি বয়ে আনতে পারে। শারীরিক শিক্ষা মূলত জীবনের শিক্ষা। খেলাধুলা নিজেকে রক্ষা করতে শেখায়। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল যুবসমাজ প্রয়োজন। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এতে তারা যেমন সম্মানিত হবেন, তেমনি জাতিও বেড়ে উঠবে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে।
শিশুদের জন্য খেলাধুলা খুবই জরুরি। শিশুর বিকাশে সাহায্য করে খেলাধুলা। বিশেষ করে শিশুর জন্য দরকার স্বাধীন খেলাধুলা। খেলাধুলা বলতে প্রথমেই মাথায় আসে দৌড়ঝাঁপ, লাফালাফির কথা। শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া হয় এমন খেলাকেই অ্যাকটিভ প্লে বলা যায়।
এ ছাড়া ছবি আঁকা, রং করা, পেইন্টিং, কাটিং ও আঠালো আর্ট দিয়ে জোড়া লাগানো, মেক-বিলিভ গেমস বা প্রিটেনড প্লে বা ড্রেসআপ খেলা। খেলার মাঠের সরঞ্জামে খেলা, আরোহণ বা ক্লাইম্বিং, দোলনা, চারপাশে দৌড়ানো।
এমনকি সদ্য জন্মানো শিশুও মজার মজার খেলায় আনন্দ পায়। উপুত-পাত (টামি টাইম), গড়িয়ে যাওয়া, কোনো একটি খেলনা ধরতে এগিয়ে যাওয়া- শিশুর খেলাধুলা শুরু হতে পারে এসব করে। যখন শিশু নড়াচড়া করতে আরও অভ্যস্ত হতে শুরু করে, তখন হাততালি দিয়ে তাকে খেলতে উৎসাহ দিন। শিশুকে বসতে, হামাগুড়ি দিতে, এমনকি প্রথমবারের মতো হাঁটতে উৎসাহিত করাও ধীরে ধীরে শিশুর খেলাধুলার অংশ হতে শুরু করে।
শিশুর নড়াচড়া ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার পর্যাপ্ত জায়গা আছে-এমন যে কোনো জায়গাই খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত। শুধু লক্ষ রাখবেন শিশুর খেলার জায়গাটি যেন নিরাপদ হয়। টেবিলের কোনা কিংবা কাচের জিনিস, যেগুলোতে শিশুর আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা আছে-এমন কিছু যেন না থাকে। ক্লান্ত শিশু ঘুমায় ভালো। খেলাধুলা শিশুকে ক্লান্ত করা ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। শিশুর বাড়ন্ত শরীরের হাড় ও পেশিকে সুস্থ-সবল করে তুলতে এবং শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে খেলাধুলা খুব জরুরি।
এ ছাড়া খেলাধুলা শিশুকে পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করায়। যার কারণে শিশু আশপাশের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তার চিন্তা ও যোগাযোগ করার দক্ষতা বাড়ে। শিশু তার হাত-পা ব্যবহার করে যখনই নতুন কিছু করতে শেখে, তার আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে বাড়তে থাকে।
ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা শিশুর জীবনের পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের ভিত্তি গড়ে তোলে। দৌড়াদৌড়ি কিংবা মাঠে ঘাসের ওপর খেলাধুলা, ছোটাছুটি করে শিশু যে আনন্দ পায় তা পরে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন কাজে ‘অ্যাকটিভ’ থাকার আগ্রহ জোগায়। ফ্রি প্লে বা স্বাধীন খেলাধুলা শিশুদের স্বাধীনভাবে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করে। শিশুদের আগ্রহ ঠিক কোন বিষয়ে বেশি তা আবিষ্কারের সুযোগ করে দেয় খেলাধুলা।
ফ্রি প্লে বা স্বাধীন খেলাধুলা ভাষার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে শিশুরা একসঙ্গে খেলাধুলার ফাঁকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের পরিধি বাড়ায়। পাশাপাশি তারা একে অপরকে এমন শব্দ ও বাক্যাংশ শেখায় যা তার অভিভাবকরাও করতে পারেন না। খেলাভিত্তিক শিক্ষা একটি শিশুর সামাজিক ও মানসিক দক্ষতা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুই ধরনের খেলার ব্যবস্থা আছে- প্রাপ্তবয়স্ক-নির্দেশিত খেলা ও শিশু-নির্দেশিত খেলা। দুটিই শিশুর বিকাশের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্ক-নির্দেশিত খেলার মধ্যে আছে- শিশুদের সঙ্গে স্পঞ্জ পেইন্টিং, বাগানে খেলা, বোর্ড গেমস খেলা, মৃৎশিল্পের ক্লাস বা আর্টক্লাসে নিয়ে যাওয়া, লুকোচুরি খেলা কিংবা একসঙ্গে রান্না করা ইত্যাদি।
খেলা একটি সৃজনশীল কার্যকলাপ। শিশুরা প্রতিনিয়ত নিজেদের বিনোদনের জন্য নতুন নতুন গেম ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ে চিন্তা করে। উদাহরণস্বরূপ, শিশুরা গল্প ও ঘটনা তৈরি করে নিজেদের মতো এবং সেগুলো এমনভাবে কাজ করে যেন বাস্তবে তা ঘটছে। নির্মাণের খেলনা দিয়ে খেলার সময় একটি বিল্ডিংয়ের নকশা তৈরি সৃজনশীলতা নিয়ে আসে। সব ধরনের খেলাই সৃজনশীল অভিব্যক্তির বিকাশ ঘটায়। আপনি কীভাবে আপনার ছোট শিশুকে সৃজনশীলতায় উৎসাহিত করতে পারেন তা অবশ্যই জানতে হবে। একটি শিশুর সামাজিক দক্ষতা শেখার প্রথম উপায় হলো তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে যোগাযোগ। এরপর ভাই-বোন বা বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
স্বাধীনভাবে খেলা চলাকালীন শিশুরা অনেক সামাজিক দক্ষতা শেখে, যেমন- অন্যদের সহযোগিতা করা, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, ভাবের আদান-প্রদান, বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা, নিয়ম মেনে চলতে শেখা ইত্যাদি। পাশাপাশি অন্যদের নিয়ে চিন্তা করা কিংবা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা ও বোঝা, ন্যায্য ও স্বাধীনভাবে মনোমালিন্যের সমাধান, বন্ধুদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা, অন্য বন্ধুদের নেতৃত্ব অনুসরণ, সহানুভূতিশীল আচরণ, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ এবং সবার সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রক্ষা করাও শেখে শিশুরা।
জীবনের শুরুতে পরিকল্পনা দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন খেলাধুলা বা ফ্রি প্লে একটি শিশুকে যৌক্তিকভাবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে একটি কাজ শুরু করার জন্য কীভাবে পরিকল্পনা করতে হয় তা জানতে সাহায্য করে। খেলার সময় শিশু একটি বাড়ি তৈরির আগে পরিকল্পনা করে বা একটি পৃষ্ঠায় একটি ছবি কোথায় আটকানো হবে তা বোঝার চেষ্টা করে। এ সবই শিশুর পরিকল্পনা করার ক্ষমতা বিকাশ করে। পরিকল্পনা এমন একটি দক্ষতা যার জন্য যত্নশীল চিন্তাভাবনা ও বিবেচনার প্রয়োজন হয়। শিশু খেলা বা কাজ শুরু করার আগে পছন্দসই ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখে এবং কীভাবে কাজটি সম্পাদন করা যায়, সে সম্পর্কে চিন্তা করতে সময় নেয়।
শিশুদের গ্রসমোটর ও সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতাগুলো মূলত স্বাধীন খেলার মাধ্যমে বিকশিত হয়। পড়তে ও লিখতে উন্নত মোটর দক্ষতার প্রয়োজন। শরীরের বড় পেশিগুলো খেলার মাধ্যমে বিকশিত হয়, যেমন- হাঁটা ও দৌড়ানো, ক্লাইম্বিং বা আরোহণ, ঝুলানো, লাফানো, ক্রলিং, ঠেলাঠেলি, টানাটানি, ধরাধরি, বল বা অন্য কিছু নিক্ষেপ করা। আবার শরীরের ছোট পেশিগুলোও খেলার মাধ্যমে বিকশিত হয়, যেমন- ব্লক বা নির্মাণ খেলার খেলনা দিয়ে বিল্ডিং, ছবি আঁকা এবং সেগুলো কাটা, থ্রেডিং ও লেসিং। সাম্প্রতিক সময়ে স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়ায় শিশুর খেলার সময় কমে গেছে। তবে সব শিশুকেই স্বাধীনভাবে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।
স্বাধীন খেলাধুলা বা ফ্রি প্লে খেলার সময় প্রতিটি শিশু একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে খেলার সময় সে কোন সমস্যার কী সমাধান করবে তা সে নিজেই বেছে নেয়। ফলে তার বিকাশ ঘটে ভালোভাবে। যখন শিশুরা প্রতিদিন খেলার জন্য অবসর সময় কাটাতে অভ্যস্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে স্বাধীনতা বোধ তৈরি হয়।
অভিভাবক হিসেবে আমাদের কর্তব্য শিশুদের প্রতিটি খেলায় উপস্থিত না থাকা। তাহলে শিশু আপনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না। শিশুকে খেলার দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিন। টানেলের মধ্য দিয়ে আরোহণ, চারপাশে দৌড়ে, মুভমেন্ট গেম খেলে, মধ্যরেখা অতিক্রম করার মতো স্বাধীন খেলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটতে পারে। অন্যদিকে মানসিকভাবে দুর্বল শিশুরা প্রায়ই কোনো খেলার সময় অন্য শিশুদের সঙ্গে ধাক্কা খায়। যদি শিশুদের স্পেশাল সেন্সের ঠিকমতো বিকাশ না ঘটে, তবে পরবর্তী সময়ে শব্দ ও অক্ষর লিখতে সমস্যা হয়। একটি অক্ষর খাতার পেজের মার্জিনের ভেতরে না বাইরে থাকবে, সেটা সে বুঝতে পারে না।
এজন্য শিশুর বিকাশের মূলে রয়েছে ‘খেলাধুলা’। যদি স্বাধীন খেলাধুলা হয়, সেটা আরও ভালো। শিশুরা খেলার মাধ্যমে বিশ্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে ও শেখে। খেলার মধ্য দিয়েই তারা চারপাশের পরিবেশের সন্ধান করে, তা থেকে শব্দভান্ডার তৈরি করে এবং তাদের আবেগ প্রকাশ করে। অবশ্যই আমাদের উৎসাহ দিতে হবে ফ্রি প্লে বা স্বাধীন খেলাধুলার প্রতি। আধুনিক শারীরিক শিক্ষা হলো শিশুর ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ও শিক্ষাশ্রয়ী একটি প্রচেষ্টা। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক দিকের বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খেলাধুলার শিক্ষাসূচি প্রণীত হয়।
তাই খেলাধুলার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গড়ে উঠছে এই শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানের সমন্বয়ে। খেলাধুলা এমন একটি বিষয়, যার সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে যে হারে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ জটিল ও কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে, তাতে এসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে দেশে ব্যাপকভাবে শারীরিক শিক্ষার প্রচলন করা প্রয়োজন।
কালের বিবর্তনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ডিসিপ্লিন হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও তা হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের দেশে শারীরিক শিক্ষা সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা। পৃথিবীর যে দেশ শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে যত উন্নত, সে দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খেলাধুলায় তত উন্নত। আমরাও খেলাধুলায় উন্নত হতে চাই। আগামীর জন্য একটি সুস্থ জাতি চাই। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং অভিভাবকদের সচেতনতার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।