এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরান ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসেবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এ জন্য ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।
সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নেই। এমনকি রাস্তার ফুটপাথ... তাও নেই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার ওপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিংয়ের ওপর বিল্ডিং। এ রকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকালগুলো রঙিন হওয়ার কথা ছিল, সেই বিকালগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।
এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার ওপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সব লোম এক মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক ওপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে এলো। ভূতপ্রেতের মতোন এত বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সি হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াল। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই... আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।
ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেও ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার ওপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আইকিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।
তা হলে তোমরা এত সুন্দর করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বলো? তোমরা কি জানো না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?
আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবু তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবু মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।
ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি... এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?
আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগল। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিল। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনও মিথ্যামুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তা হলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।
এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হলো। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যামুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব....। বাই...।
আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবু ইকুচুর দিকে হাত নেড়ে জানাল, বাই ইকুচু... বাই।