হঠাৎ করেই তৈরি পোশাক শিল্পসহ আরও কয়েকটি শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার এবং টঙ্গী এলাকার প্রায় ৫০টির মতো কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছে। ক্রমান্বয়ে আরও অনেক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করে শুরু হওয়া এই শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যারা ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত এবং শিল্প এলাকায় চাঁদাবাজি করত তারা।
তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পতনের পর নতুন চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। মূলত শিল্প এলাকায় ঝুট ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শ্রমিকদের উসকে দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে সাবেক প্রধানমমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কারখানার শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও দেনা-পাওনার বিষয়।
জানা গেছে, বিগত ৫-৬ বছর ধরে এই বিতর্কিত ব্যবসায়ীর ওষুধ শিল্প কারখানা এবং তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেক শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বকেয়া বেতন পাবেন। আবার অনেক চাকরিচ্যুত শ্রমিক ৫-৬ বছরের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পাবেন। এসব দাবিতেও সালমান এফ রহমানের কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছে।
চলমান আন্দোলনের নেপথ্যে আরও কিছু কারণ রয়েছে বলে জানা গেছে। শ্রমিক নেতা ও শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে তৈরি পোশাক শিল্পে যত শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগই নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিক বেশি নিয়োগ দেওয়ায় পুরুষ শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা এখন দাবি তুলেছেন-নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের যে ডাটাবেজ বা তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার এই প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিও তুলছেন আন্দোলনরত শ্রমিক নেতারা। শ্রমিকদের আরেক দাবির মধ্যে রয়েছে, কয়েক মাস আগে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের যে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে, এখন আবার নতুন করে মজুরি বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি কারখানায় কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে নেমেছে।
তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, এসব ছোটখাটো দাবির আড়ালে আসলে সুবিধাভোগী গ্রুপ শ্রমিকদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি তৌহিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘বিদায় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যারা তৈরি পোশাক শিল্পের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত তারা আবার সক্রিয় হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওইসব সরকারদলীয় চাঁদাবাজরা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক মনে করায় এবং বর্তমান সরকার কিছুটা নমনীয়ভাবে চলায় তারা এখন নিরাপদ মনে করছেন নিজেদের। আত্মগোপনে থেকে তারা এখন বের হয়ে আবার শিল্প এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছেন। এ ছাড়া সরকার পতনের পর নতুন চাঁদাবাজরাও সক্রিয় হয়েছে। এই নতুন-পুরোনো চাঁদাবাজরা শিল্প এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব নিতে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে শিল্পে অস্থিরতা করতে চাচ্ছেন। তাই আমরা যারা শ্রমিক নেতৃত্বে আছি তারা, সাধারণ শ্রমিকদের বুঝাচ্ছি কারও ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এখনও এক মাস হয়নি। এখনই দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামা যাবে না। সরকারকে সময় দিতে হবে।’
অস্থিরতা বন্ধে শিল্পাঞ্চলে যৌথ অভিযান : পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে শিল্পাঞ্চলে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা থামাতে এবং এই আন্দোলনে ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু হয়ছে গতকাল সোমবার রাত থেকেই। একসঙ্গে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশের যৌথ অভিযান শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর (অব.) সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠক শেষে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের যৌথ অভিযান শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের কোনো ধরনের হয়রানি না করতে আমরা বিশেষভাবে অনুরোধ করেছি।’
অন্যদিকে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল রাকিব বলেন, বর্তমান অস্থিরতার পেছনে একটি গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে। তাদের লোকজন লুঙ্গি পরে হেলমেট মাথায় দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে অস্থিরতা তৈরি করছেন এবং কারখানা ভাঙচুর করছেন। ফলে যারা শ্রমিকদের উসকে দিয়ে আন্দোলনে নামাচ্ছেন এবং শ্রমিক না হয়েও যারা আন্দোলন করছেন ও কারখানা ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
আশুলিয়ায় বিক্ষোভ মুখে ৩০ কারখানা ছুটি ঘোষণা : আশুলিয়া ও গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, ঢাকার আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় নারী-পুরুষের সমানুপাতিক হারে নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল আবদুল্লাহপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন চাকরিপ্রত্যাশী শ্রমিকরা। সোমবার সকাল ৯টার দিকে আশুলিয়ার ডিইপিজেড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। পরে অবশ্য বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের নিশ্চিন্তপুর, জামগড়া এলাকার বিভিন্ন কারখানার সামনে জড়ো হওয়া চাকরি প্রার্থীরা বিক্ষোভ করে সড়ক থেকে সরে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, সকালে বেশ কিছু লোক লাঠিসোটা নিয়ে জামগড়া এলাকার ‘দি রোজ’ কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে তারা আইডিএস কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়ে চলে যায়। তারা আসলে শ্রমিক কি না তা বোঝা যায়নি। তবে তারা চাকরি প্রার্থী হতে পারেন। কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়লে সড়কের দুই পাশের প্রায় সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছেন বেকাররা। এ ছাড়াও পোশাক কারখানায় নারী-পুরুষের সমানুপাতিক হারে নিয়োগের দাবিসহ আরও কয়েকটি দাবি রয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের অবরোধ তুলে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ডিইপিজেড এলাকার অবরোধ তুলে নিতে আন্দোলনকারীদের বোঝানো হচ্ছে। তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গাজীপুরে বিক্ষোভ : গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ অবরোধ করে চাকরি স্থায়ীকরণ, বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। সোমবার সকাল থেকে চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগরা, নাওজোর, কোনাবাড়ী, বোর্ডবাজার ও টঙ্গীতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কয়েকটি স্থানে থেমে থেমে এবং কয়েকটি স্থানে দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় ভোগান্তি পড়ে ওই মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীরা।
চাকরির দাবিতে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিক্ষোভ, কারখানা ভাঙচুর করেছে চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে টঙ্গীর বিসিক এলাকায় এ বিক্ষোভে যোগ দেয় কয়েকশ শ্রমিক। এ সময় চাকরিচ্যুত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ১১টি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালায়। এ সময় চাকরিচ্যুত দুজন শ্রমিক, একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ আহত হয়। আন্দোলনকারীরা আহত বাদশা মিয়াকে (২১) উদ্ধার করে টঙ্গীর শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয় এবং অন্য অজ্ঞাত এক নারী শ্রমিককে নিজ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সময়ের আলো/জেডআই