বন্যার পানির কমার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীতে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। এতে আতঙ্কে রয়েছে বন্যার শিকার জেলার আটটি উপজেলার বন্যার্তরা। আর লক্ষ্মীপুরে ধীরগতিতে কমছে বন্যার পানি। দীর্ঘসময় পানিবন্দি অবস্থা থাকায় পানিবাহিত রোগবালাই দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকায়। অন্যদিকে জেলায় কুমিল্লায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার।
সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সময়ের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানির কমার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীতে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। জেলার বন্যার শিকার আটটি উপজেলায় এখন পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া দেখা দেওয়ায় বন্যার্তরা রয়েছে আতঙ্কে। তারা পর্যাপ্ত সেবা ও ওষুধ সংকটেও রয়েছে। এ ছাড়া জেলায় এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আছে প্রায় ২ লাখ বানভাসি। বন্যার কারণে মারা গেছে ১১ জন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৭০০ শতাধিকের বেশি ডায়রিয়া রোগী সেবা নিয়েছে। সোমবার সকাল ১০ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে তিন শতাধিক রোগী। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ওষুধসহ নার্স ও চিকিৎসক সংকটও রয়েছে।
সরেজমিন হাসপাতালটির ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দেখা যায়, ওয়ার্ডের কক্ষ, মেঝে ও করিডোরে রোগীর ভিড়। এর ৯৫ শতাংশই শিশু। জায়গা না হওয়ায় অস্থায়ী ওয়ার্ডও খোলা হয়েছে পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনে। সেখানে কোনো শয্যা নেই। মেঝেতে চলছে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা। কোনো কোনো শয্যায় একসঙ্গে দুজন রোগীকেও থাকতে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে অবস্থান করার সময় দেখা যায় নতুন নতুন রোগী আসছে। বেশিরভাগই শিশু। বয়স্করাও রয়েছে।
চাটখিল উপজেলার আকতার হোসেন বলেন, ছেলের প্রথমে পাতলা পায়খানা দেখা দেয়। স্থানীয়ভাবে পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় এখানে ভর্তি করেছি। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বন্যার যত উন্নতি হচ্ছে, ডায়রিয়া রোগী তত বাড়ছে। বেশিরভাগই শিশু। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের সংকট রয়েছে। এরপরও সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া হচ্ছে। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ তিনি নাকচ করে বলেন, আমরা সাধ্যমতো সেবা অব্যাহত রেখেছি। স্যালাইন ও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় আরও ওষুধ আসছে।
এদিকে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির আস্তে আস্তে উন্নতি হয়েছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সমস্যা ও সংকট। এখনও অনেক নিচু এলাকায় পানি থাকায় ঘরে ফিরতে পারছে না আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া অনেক বানভাসি। জেলাতে এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আছে প্রায় ২ লাখ বানভাসি। বন্যায় বিভিন্নভাবে মারা গেছে ১১ জন।
জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে আটটি উপজেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এসব উপজেলায় এখনও কোথাও হাঁটু সমান বা কোথাও হাঁটুর নিচে পানি রয়েছে ও বসতঘরে এখনও পানি আছে। ধীরে ধীরে পানি নামায় বাসভাসিরা আরও কষ্টে আছে। তারা ঘরেও থাকতে পারছে না, আবার কাজেও যেতে পারছে না। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষরা রয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলাতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। খাল-নালা-জলাশয় পরিষ্কার করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ কেটে দিয়ে পানি চলাচলের পথ স্বাভাবিক করা হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুরে ধীরগতিতে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও দুর্গত এলাকায় এর প্রভাব খুব বেশি পড়েনি। সদর উপজেলার বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রতিদিন কোথাও এক ইঞ্চি, কোথাওবা দুই ইঞ্চি পানি কমছে। এখনও পানিবন্দি রয়েছে জেলার ৮ লাখের বেশি মানুষ। এতে বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলছে। গত ১৫ দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থা থাকায় পানিবাহিত রোগবালাই দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকায়।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইউনুস মিয়া বলেন, সোমবার পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ জন পানিবন্দি হয়ে আছে। জেলার ৪১৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৩২ হাজার ৫১৯ জন। জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা এখনও পানির নিচে। তিনি বলেন, পানি ধীরগতিতে নামছে। দিনে এক থেকে তিন ইঞ্চি পানি কমছে।
কুমিল্লা সংবাদদাতা জানান, জেলায় কুমিল্লায় বাড়িঘর হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার।
জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, জেলায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি ছিল। ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ৩৯ লাখ নগদ টাকা ও ৮০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কুমিল্লা জেলায় ১ হাজার ৬০০ টন চাল, নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার ম. মুশফিকুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান। আমরা আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে তাদের।
সময়ের আলো/জেডআই