ই-পেপার মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রা‌মে‌বির ভি‌সির ইশারাতে হতো অনিয়ম-দুর্নীতি, অব‌শে‌ষে পদত্যাগ
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮:৫৮ পিএম  (ভিজিট : ১৬৬)
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এজেডএম মোস্তাক হোসেন পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করলেও তার বিরুদ্ধে ছিল দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। তার ইশারাতেই হতো এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি। রামেবিতে নিয়োগেও ছিল ব্যাপক অনিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজশাহীতে হলেও তিনি থাকতেন ঢাকায়। সেখানকার গেস্ট হাউজে বসে তিনি অফিস করতে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলকাঠি নাড়তেন। 

সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। 

মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রামেবির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও সেকশন অফিসার জামাল উদ্দীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

তিনি বলেন, উপাচার্য ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করছেন বলে পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন। এখন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

এর আগে ২০২১ সালের ২৭ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেনকে চার বছরের জন্য রামেবির ভিসি নিয়োগ দেয় সরকার। ছাত্রজীবনে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন।

ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন উপাচার্য থাকা অবস্থায় কোনো চাকরি বিধিমালা ছিল না। তিনি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্ধারিত বেতন-ভাতার চেয়ে বেশি নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের কাজে যথোপযুক্ত বিভাগকে কাজে না লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পেও নানা দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটানো হচ্ছে তার ইশারায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারেও চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সভা হলে উপাচার্য বিমানে আসা-যাওয়া করতেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। সভাগুলোতে খরচ করা হতো লাখ টাকার ওপরে। সবশেষ রা‌মে‌বির সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৮ মে। রাজশাহী নগরীর একটি অভিজাত আবাসিক হোটেলে এই সভার আয়োজন করা হয়। এ সভার পেছনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। সভায় যোগ দিতে ঢাকা থেকে বিমানে রাজশাহীতে আসেন উপাচার্য ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন। তার পেছনেও খরচ করতে হতো অনেক টাকা। 

রামেবির কর্মকর্তারা বলছেন, উপাচার্য ঢাকা থেকে অফিস করতেন। তিনি রাজশাহীতে না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় ও দাফতরিক কাজ কর্মকর্তাদের করতে হতো। এজন্য বিড়ম্বনায় পড়তেও হতো। 

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালে। উপাচার্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন ২০২১ সালে। প্রতিষ্ঠা হওয়ার পাঁচ বছরেও জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। ভূমি অধিগ্রহণসহ অবকাঠামো নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৬৭.০৮ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে গাফিলতি ও সঠিক তদারকির অভাবে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৫৭.৯৪ কোটি টাকায়। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিকল্পনা শাখার জনবল থাকার পরও এ-সংক্রান্ত কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রামেবির লিয়াজোঁ ও প্রটোকল অফিসার এবং উপাচার্যের পিএস (দুর্নীতি ও জাল সনদে চাকরির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত) ইসমাঈল হোসেনকে। যা নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। তিনি এগুলো সব করতে। আর কলকাঠি নাড়তেন উপাচার্য ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন।

এবছরের ৪ মার্চ ইউজিসির বাজেট পর্যালোচনা দল রামেবিতে এসে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অনিয়ম তুলে ধরে। প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বলা হয়, উপাচার্য নিয়োগ শর্তানুযায়ী তিনি সরকারি চাকরিতে আহরিত সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতনের সমপরিমাণ বেতন-ভাতাদি প্রাপ্য হবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য তার বেতন-ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতনের সঙ্গে উৎসব ও নববর্ষ ভাতা যোগ করে বেতন নির্ধারণ পূর্বক ভাতাদি নির্ধারণ করেন। এভাবে তার বেতন-ভাতার পরিমাণ সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতন-ভাতার চেয়ে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে; যা নিয়মের ব্যত্যয় ও আর্থিক ক্ষতি। 

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত কোনো অর্গানোগ্রাম নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকলেও এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত চাকরি বিধিমালা করাও সম্ভব হয়নি। বেতন নির্ধারণী কমিটি ছাড়াই বেতন নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়েরও কোনো সঠিক হিসাব নেই। ফলে বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ। এমন একটি পদে থেকেও ভিসি মোস্তাক হোসেন দিনের পর দিন ঢাকায় থেকে অফিস করতেন। ঢাকায় অবস্থিত রামেবির গেস্ট হাউসকে তিনি লিয়াজোঁ অফিসে পরিণত করেছেন। রামেবিতে ডিনের আটটি পদের সবগুলোই বর্তমানে শূন্য। এ অবস্থায় উপাচার্যের অনুপস্থিতির ফলে প্রশাসনিক কাজে একদিকে ছিল স্থবিরতা, অন্যদিকে সঙ্কট আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। তিনি মাসে দুয়েকদিন রাজশাহীতে এসে অফিস করতেন। 

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র প্রকাশ করা হয়। রামেবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট (পরিচালন) বরাদ্দ এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পালনীয় গাইডলাইন বিষয়ক এই পরিপত্রের ৫ নং পয়েন্টে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউস ছাড়া কোনোরূপ অফিস বা লিয়াজোঁ অফিস অথবা অন্য কোনো নামে অফিস করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

রামেবির লিয়াজোঁ ও প্রটোকল অফিসার এবং উপাচার্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইসমাঈল হোসেন জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নেন বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ ওঠার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং জালিয়াতির প্রাথমিক সত্যতাও পাওয়া যায়। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম সিন্ডিকেট সভায় ইসমাঈল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ভিসি নানা কৌশলে সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেননি। বরং বরখাস্তের পরও ভিসি তাকে ঢাকায় রামেবির গেস্ট হাউসের লিয়াজোঁ অফিসে বসিয়ে তাকে দিয়ে দাফতরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করিয়েছেন। 

রামেবির বিভিন্ন সময় দেওয়া নিয়োগের অনিয়ম খুঁজে পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারা বেশকিছু বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করে। গেল বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রামেবির কার্যালয়ে হানা দেয় দুদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে প্রেষণে বারবার একই কর্মকর্তাদের নিয়োগ, কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দেওয়া এবং নিয়োগ পেয়ে দিনের পর দিন অফিস ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে দুদক।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজশাহীর সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, ‘সেই সময়ের নথিপত্র আমরা রামেবি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। এগুলো তদন্ত করে আমরা কমিশনে পাঠিয়েছি। কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

রামেবির দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. জাকির হোসেন খন্দকার এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবো না।’ 

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য রামেবি থেকে পদত্যাগ করা উপাচার্য  অধ্যাপক ডা. এজেডএম মোস্তাক হোসেনের মুঠোফোনে একাধিক বার কল দেওয়া হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাই তার বক্তব্য নেওয়াও সম্ভব হয়নি। 

সময়ের আলো/আরআই


আরও সংবাদ   বিষয়:  রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-উপাচার্যের পদত্যাগ  




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close