আলগা বল দিয়েছিলেন আবরার আহমেদ, তাতে সপাটে ব্যাট চালিয়ে দিলেন সাকিব আল হাসান। বুলেট গতিতে বল কাভার অঞ্চল দিয়ে সীমানাছাড়া। এর আগেই হুংকার-সাকিবের নয়, অন্যপ্রান্তে থাকা মুশফিকুর রহিমের। সাকিব শটটা খেলার পরই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এই শটেই সারা আরেকটি ঐতিহাসিক জয় এবং ধবলধোলাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
ওটা আনুষ্ঠানিকতাই, কেননা রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে বাংলাদেশের জয় লেখা হয়ে গিয়েছিল আগের দিনই। শঙ্কা ছিল কেবল বৃষ্টি নিয়ে। না, মঙ্গলবার আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে বৃষ্টি বাগড়া দেয়নি। টিম বাংলাদেশ তাই আরাম-আয়েসে খেলেই তুলে নিয়েছে ৬ উইকেটের জয়। যে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ১৩ টেস্টে কোনো জয় ছিল টাইগারদের, টানা দুই টেস্টে তাদেরই হারিয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল, সেটিও কি না প্রতিপক্ষেরই আঙিনায়।
রাওয়ালপিন্ডিতেই সিরিজের প্রথম টেস্ট জিতে ইতিহাস গড়ার মঞ্চটা তৈরি করে রেখেছিল টিম বাংলাদেশ। দেশে ফেরার বিমান ধরার আগে মঙ্গলবার সেটিকে তারা দিয়েছে পূর্ণতা। বারবার বৃষ্টির বাগড়ায় দ্বিতীয় টেস্টের শুরুটা ছিল রোমাঞ্চকর, লড়াই চলেছে সমানে সমান, তবে শেষটা ছিল একপেশে। বাংলাদেশের জয়টাই বনে গিয়েছিল নিয়তি। সাকিব-মুশফিক যখন সেই নিয়তিরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলেন, রাওয়ালপিন্ডির ড্রেসিংরুমের বারান্দায় তখন বেশ ভিড়। সবাই তখন উদযাপনের অপেক্ষায়। অপেক্ষা ঘুচে যায় সাকিবের শটে, তৎক্ষণাৎ মুশফিকের বজ্র হুংকার।
ড্রেসিংরুমের বারান্দায় তখন উৎসব। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন শান্ত। অধিনায়কের সঙ্গে গলা মেলান দলের অন্যরাও। দেশের বাইরে তৃতীয় সিরিজ জয়ের আনন্দ যেন ছাপিয়ে গেল সবকিছুকেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক টেস্টের সিরিজটা বাদ দিলে দ্বিতীয় সিরিজ জয়, পূর্ণ শক্তির কোনো দলের বিপক্ষে প্রথম। ২০০৯ সালে বিদেশের মাটিতে প্রথমবার সিরিজ জিতেছিল টাইগাররা, ধবলধোলাইয়ের (২-০) ঘটনাও ওটাই প্রথম। কিন্তু বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলার জেরে ওই সিরিজে ছিলেন না ওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষ ক্রিকেটাররা।
এবার পাকিস্তান খেলেছে পূর্ণ শক্তি নিয়ে। নিজ আঙিনায় সবটুকু নিংড়ে দিয়ে লড়াইও গড়েছে শান মাসুদের দল। কিন্তু শান্তর দলকে পেয়ে বসেছিল ইতিহাস গড়ার নেশা। তাই স্বাগতিকদের প্রচেষ্টা পূর্ণতা পায়নি। প্রথম টেস্টে ৪৪৮ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছিল তারা, প্রায় চার দিন লেগে গিয়েছিল দুই দলের প্রথম ইনিংস শেষ হতে, বাকি সময়টাকেই জয়ের জন্য যথেষ্ট বানিয়ে ফেলে টাইগাররা। দ্বিতীয়টিতেও স্বাগতিকদের শুরুটা ছিল দারুণ। তবে শেষটা ছিল বাংলাদেশের।
প্রথম ইনিংসে ২৭৪ রান তুলে ২৬ রানে বাংলাদেশের ৬ উইকেট ফেলে দিয়েছিল পাকিস্তান। ম্যাচের লাগাম তখন পুরোপুরিই ছিল স্বাগতিকদের হাতে। এরপর লিটন দাস (১৩৮) আর মেহেদী হাসান মিরাজের (৭৮) ব্যাটিং বীরত্বে ঘুরে দাঁড়ানো, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২৬২ রানে অলআউট হয়ে প্রথম ইনিংসে ১২ রানে পিছিয়ে থাকলেও পেসারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ম্যাচের লাগাম নিজেদের হাতে নেয় টাইগাররা। হাসান মাহমুদ (৫/৪৩), নাহিদ রানা (৪/৪৪) আর তাসকিন আহমেদ (১/৪০) জয়ের মঞ্চ গড়ে দেন ১০ উইকেট তুলে নিয়ে।
প্রথমবার টাইগার পেসারদের ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তিতে দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান অলআউট হয় ১৭২ রানে, তাতে জয়ের জন্য ১৮৫ রানের লক্ষ্য পায় বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনের শেষবেলায় ৭ ওভার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ৪২ রান তুলে ফেলেন দুই ওপেনার জাকির হাসান আর সাদমান ইসলাম। শেষদিনে তাই জয়ের জন্য ১৪৩ রান প্রয়োজন ছিল। জাকির (৪০), সাদমানরা (২৪) দ্রুত বিদায় নিলেও প্রয়োজনটা মেটাতে সমস্যা হয়নি পরবর্তী ব্যাটারদের। সময়ের দাবি মিটিয়ে ৩৮ রানের ইনিংস খেলেন শান্ত, ৩৪ রান আসে মুমিনুল হকের ব্যাট থেকে। এরপর ২২ রানে মুশফিক আর ২১ রানে অপরাজিত থেকে সাকিব টানেন ম্যাচের ইতি।
২৬ রানে ৬ উইকেট হারানোর ধাক্কা সামলে পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়িয়ে এমন জয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটেও আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে। কেননা প্রথম ইনিংসে এত কম রানে ৬ উইকেট হারানোর পরও কোনো দলের টেস্ট জয়ের ঘটনা যে ঘটল ১৩৭ বছর পর। অনেক পুরোনো ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া জয়েই বাংলাদেশের সিরিজ জয়, ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায় দুই যুগের পথচলায় সবমিলিয়ে নবম, এক টেস্টকে সিরিজ না ধরলে পঞ্চম। একাধিক টেস্টের সিরিজে দুবার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর এবার পাকিস্তানকে হারাল টাইগাররা।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ২০০৩ সালের পাকিস্তান সফর। সেবার ৩-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হয়েছিল টাইগাররা, তবে খেলেছিল দুর্দান্ত। ওই সিরিজটা তাই আক্ষেপ হয়েই আছে। এবারের ঐতিহাসিক ধবলধোলাই কিছুটা হলেও তা ঘুচিয়ে দেবে, সিরিজটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে টাইগার ক্রিকেট ইতিহাসেও।
সময়ের আলো/আরএস/