প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৮:২৭ পিএম (ভিজিট : ১৩৯৭)
আধুনিক কাটিং ও কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ করে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কৃষক সফলতার মুখ দেখছেন। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ। এ সফলতা দেখে যেমন অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন, তেমনি উদ্ভাবক নজরুল ইসলামের এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ দেশের বিভিন্ন জেলায়ও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
পুরনো পদ্ধতিতে বাঁশ লাগানোর পর বাঁশের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় বাঁশঝাড় দেখে গাইবান্ধার কৃষি বিভাগের সাবেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম বাঁশঝাড় রক্ষায় চেষ্টা করতে থাকেন। ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে (১৯৬৮ সাল) তিনি নিরলসভাবে গবেষণা শুরু করেন। প্রথমেই কাটিং পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ করেন; কিন্তু কোনোভাবেই এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষের সফলতা আসছিল না। এভাবে প্রতি বছরই গবেষণা করতে থাকেন আর নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। বিভিন্ন নিয়মে বাঁশের কাটিং পদ্ধতি চালিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর পর এই পদ্ধতিতে বাঁশ চাষে সফল হন তিনি। প্রথমেই তিনি নিজের বাড়িতে এবং গাইবান্ধা জেলার ২০টি গ্রামের ৩০ বিঘা জমিতে কাটিং পদ্ধতিতে বাশ চাষ করে সাফল্য অর্জন করেন।এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ করে খুব অল্প সময়ে বাঁশ ব্যবহার উপযোগী হয়, বিক্রিও করা যায় এবং নিজের কাজেও লাগানো যায়।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালীর তছিত উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে নজরুল ইসলাম। ছোটবেলা থেকেই তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল প্রকৃতি ও উদ্ভিদ। ওই সময়ই তাঁর বাড়িঘর, বারান্দা ও উঠোনে গাছের ছড়াছড়ি ছিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাই বাড়িটির নামকরণ করেন 'গাছের ল্যাবরেটরি'। ১৯৭১-এ কিশোর বয়সে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা নজরুল ১৯৭২ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর রংপুরের তাজহাটে উদ্যানতত্ত¡ বিষয়ে কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে যোগ দেন কৃষি বিভাগের চাকরিতে। বর্তমানে তিনি সাঘাটা উপজেলায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এই কীর্তিমান মুক্তিযোদ্ধা কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৫ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি সর্বশেষ বাঁশের বংশবৃদ্ধির সহজ ও বোধগম্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। দীর্ঘ একযুগের টানা গবেষণার পর সাফল্য তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। বাঁশের বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে কাটিং পদ্ধতির প্রযুক্তি সফল হওয়ায় গাইবান্ধার কৃষি সংশ্লিষ্ট সেক্টরে তাঁর নাম এখন সবার মুখে মুখে।
নিজের বাঁশ বাগানে দাঁড়িয়ে নজরুল জানান তাঁর উদ্ভাবন প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, 'বাঁশঝাড় থেকে দুই বছর বয়সী সতেজ ও সবল বাঁশ চিহ্নিত করে কেটে নিতে হবে। বাঁশের কঞ্চিগুলো দুই ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা রেখে বাকি অংশ ছেঁটে ফেলে সম্প‚র্ণ বাঁশটিকে দুই গিটের মাঝখানে করাতের সাহায্যে বাঁশের আকৃতি ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টুকরো করে নিতে হবে। এক বিঘা জমিতে বাঁশের চারা তৈরির জন্য এরকম ৩০০ টুকরোর দরকার হবে। বাঁশ টুকরো করার পর সব টুকরো একটি গর্তের ভেতরে রেখে খড় দিয়ে ঢেকে প্রতিদিন হালকা পানি সেচ দিয়ে ভেজাতে হবে। এরপর পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ দিন রাখার পর দেখা যাবে প্রতিটি গিট থেকে কুশি (নতুন পাতা) বেরিয়েছে। এরপর টুকরোগুলো তুলে নিয়ে নির্ধারিত জমিতে ৮৬ ফিট পরপর নালা কেটে তার মধ্যে বসিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এই মাটি দিয়ে ঢাকার পদ্ধতি হবেথ আলু চাষের মতো। পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই বাঁশের চারাগাছ কঞ্চির আকারে বেরুতে থাকবে। এভাবে পুরো বাঁশঝাড় তৈরি হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে।'
কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট, পঞ্চগড়, নওগাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাঁশ চাষিদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে গিয়ে বাঁশের ঝাড় স্থাপন করে দিয়ে এসেছেন নজরুল ইসলাম। নিবেদিত প্রাণ বৃক্ষ প্রেমিক এই কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, যতো দিন বেঁচে থকবেন কৃষকের পাশে থাকবেন এবং কৃষকের সাথে কাজ করবেন। দেশের যে কোন জেলার কৃষক চাইলে তার সাথে যোগাযোগ করে এই বাশ চাষ করতে পারবেন।
গাইবান্ধা প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা লেখক ও সাংবাদিক গোবিন্দলাল দাস বলেন, ‘শুধু বাঁশের বংশ বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা নয় বরং দেশকে তিনি জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। মুক্তিযুদ্ধেও নজরুল ইসলামের অবদান আছে। তার এ প্রতিভা দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’