উপমহাদেশে প্রথম
দিবা-রাত্রির টেস্ট, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে শুক্রবার শুরু হওয়া সেই টেস্টে
আয়োজনে ফাঁক রাখেনি আয়োজকরা। কলকাতার ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন
ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) গোলাপি বলের টেস্টটাকে স্মরণীয়
করেছে বর্ণিল আয়োজনে। কিন্তু মাঠের ক্রিকেট অনেকটাই রঙ হারিয়েছে প্রথম
দিনে। দায়টা বাংলাদেশের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাদেশের
ব্যাটসম্যানদের। তাদের সীমাহীন ব্যর্থতায় বহুল আলোচিত টেস্টে টাইগারদের
শুরুটা হয়েছে দুঃস্বপ্নের মতো। ১০৬ রানে অলআউট হয়েছে তারা। জবাবে ৩ উইকেটে
১৭৪ রান তুলে প্রথম দিনেই ৬৮ রানের লিড নিয়েছে ভারত। চেপে বসেছে চালকের
আসনে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী মততা ব্যানার্জি ‘ইডেন বেল’ বাজিয়ে টেস্টের উদ্বোধনী করেন।
এর আগেই হয়ে যায় টস। নানা আয়োজনের টেস্টটাতে টস হয়েছে বিশেষভাবে তৈরি
মুদ্রা দিয়ে। সেই মুদ্রা শূন্যে ছুড়েন ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
টসভাগ্যে তিনি নন, জেতেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মুমিনুল হক। টানা দ্বিতীয়বার
টস জিতে আগে ব্যাটিং বেছে নেন তিনি। তার সেই সিদ্ধান্ত আবারও প্রশ্নবিদ্ধ
করেছেন ব্যাটসম্যানরা। তবে কোহলি জানিয়েছেন, টস জিতলে তিনিও আগে
ব্যাটিংয়েরই সিদ্ধান্ত নিতেন।
ব্যাটিংয়ে শুরুটা আশা জাগানিয়াই ছিল।
সাদমান ইসলাম আর ইমরুল কায়েস ভালো কিছুরই আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আভাস
মিলিয়ে যেতেও সময় লাগেনি। গোলাপি বলের জটিল আচরণ বুঝে উঠতে পারেননি কেউ।
টাইগার ব্যাটারদের টেকনিকের ঘাটতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। একের পর এক ভুল শট
খেলে আত্মাহুতি দিয়েছেন সবাই, নেমেছিলেন সাজঘরে ফেরার মিছিলে। সাদমান আর
লিটন দাসের ব্যাটিংয়েই শুধু কিছুটা লড়াইয়ের ছাপ দেখা গেছে। কিন্তু সেটাও
ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। দলের পুঁজিতে সর্বোচ্চ ২৯ রান জমা
করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন সাদমান, ২৪ রান করা লিটন ফিরেছেন
রিটায়ার্ড হার্ড হয়ে।
ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামির বাউন্সার আঘাত হানে
লিটনের হেলমেটে। মাঠেই শুশ্রƒষা নিয়ে সামলে উঠেছিলেন এই কিপার ব্যাটসম্যান,
আবার ব্যাটিং শুরু করেন। কিন্তু অস্বস্তি বোধ করায় মাঠ ছেড়ে যান তিনি।
ছিটকে গেছেন ম্যাচ থেকেও। আইসিসির নতুন নিয়মে (কনকাশন সাব) তার বদলি হিসেবে
ব্যাটিংয়ে নামেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ৮ রানের বেশি করতে পারেননি তিনি।
হাসপাতালে যেতে বাধ্য হওয়া লিটনের মতো শামির বাউন্সার দিবা-রাত্রির এই
টেস্ট শেষ করে দিয়েছে নাঈম হাসানেরও। তার কনকাশন বদলি হিসেবে ফিল্ডিংয়ে
নেমেছেন তাইজুল ইসলাম। নাঈম অবশ্য আউট হয়েই মাঠ ছেড়েছেন, করেছেন ১৯ রান।
সাদমান,
লিটন আর নাঈম বাংলাদেশের ইনিংসে দুই অঙ্কের রানে যেতে পেরেছেন এই তিনজনই।
বাকিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ রান মিরাজের। ৬ রান এসেছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের
ব্যাট থেকে। ২২ রানে ৫ উইকেট নেওয়া ইশান্ত শর্মার বলে ডানহাতি এই
ব্যাটসম্যান যখন ঋদ্ধিমান সাহার দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত হন, বাংলাদেশের
স্কোর তখন ৬০/৬! তখনও ২০তম ওভারের খেলা শেষ হতে দুই বল বাকি! এরপর
রিটায়ার্ড হার্ড হয়ে লিটনের মাঠ ছেড়ে যাওয়া, মধ্যাহ্নভোজের বিরতিটাও শুরু
তখন। বিরতির পর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি বাংলাদেশের ইনিংস। ৩০.৩ ওভারে অলআউট
হয়েছে মুমিনুলের দল। বলতে গেলে একটি সেশনই ব্যাট করতে পেরেছে অতিথিরা।
দলের
এমন ব্যাটিং ব্যর্থতায় দায় আছে মুমিনুলেরও। বিদেশের মাটিতে বরাবরই কিছুটা
ছন্দহীন এই বাঁহাতি এদিন রানের খাতাই খুলতে পারেননি। স্লিপে রোহিত শর্মার
দুর্দান্ত এক ক্যাচে বলি হয়ে ফিরেছেন সাজঘরে। সমানভাবে দোষী মোহাম্মদ মিঠুন
আর মুশফিকুর রহিমও। তারাও সাজঘরে ফিরেছেন রানের খাতা খোলার আগে। ২৯ রানে ৩
উইকেট নেওয়া উমেশ যাদবের করা ইনিংসের একাদশতম ওভারে তিন বলের ব্যবধানে
ফেরেন মুমিনুল আর মিঠুন। পরের ওভারে মোহাম্মদ শামির বল মুশফিকের ব্যাট ছুয়ে
উপড়ে দেয় স্টাম্প। ব্যাটিং অর্ডারে তিন, চার আর পাঁচে নামা ব্যাটসম্যান
শূন্য রানে আউট, ১৪২ বছরের যাত্রায় টেস্ট ক্রিকেট দেখল পঞ্চমবারের মতো।
উপমহাদেশের মাটিতে ঘটল প্রথমবার।
এই ধাক্কাটাই আসলে সামলে উঠতে পারেনি
বাংলাদেশ। উদ্বোধনী জুটিতে ১৫ রান ওঠার পর ১৭ তেই তিন উইকেট হারায়
বাংলাদেশ, ২৬ রানে ৪ আর ৩৮ রানে ৫ উইকেট পতনের পর শঙ্কা জেগেছিল দিবা-রাত্রির টেস্টে ইংল্যান্ডের ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ডটা না আবার
ভেঙে দেয় বাংলাদেশ! মাথায় চোট পেয়ে হাসপাতালে যাওয়া এবং এই টেস্ট থেকে
ছিটকে যাওয়া লিটন আর নাঈম সেই লজ্জা থেকে উদ্ধার করেছেন দলকে।
ব্যাটিং
ব্যর্থতা ভোলার সুযোগ ছিল বোলিং দিয়ে। ভারত ব্যাটিংয়ে নামার আগেই জ¦লে ওঠে
ইডেনের ফ্লাডলাইট। যে গোলাপি বলের সুইং নিয়ে এত আলোচনা, সেই সুইং তো আরও
ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ফ্লাড লাইটের আলোতেই। শুরুটা মন্দ ছিল না। পাঁচ বছর পর
টেস্ট দলে ফেরা আল-আমিন হোসেন ইন্দোর টেস্টের ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মায়াঙ্ক
আগারওয়ালকে (১৪) পঞ্চম ওভারেই দেখান সাজঘরের পথ। আরেক পেসার ইবাদত হোসেন
যখন দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে রোহিত শর্মাকে লেগবিফোরের ফাঁদে ফেলেন, ভারতের
রান তখন ৪৩। সেখান থেকে দলকে সামনে নিয়ে গেছেন চেতেশ্বর পূজারা (৫৫) আর
কোহলি। ক্যারিয়ারের ২৪তম হাফসেঞ্চুরি তুলে ইবাদতের দ্বিতীয় শিকার হয়ে
পূজারা যখন সাজঘরমুখী স্বাগতিকদের সংগ্রহ তখন ১৩৭। আজিঙ্কা রাহানেকে (২৩*)
সঙ্গী করে দলপতি কোহলি রানটাকে ১৭৪ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। ক্যারিয়ারের ২৩তম
হাফসেঞ্চুরি তুলে ৫৯ রানে অপরাজিত আছেন তিনি।