চাঁদের আলো আর পড়ন্ত শিশিরের মাখামাখিতে ঘেরা ছাদবিহীন উন্মুক্ত মঞ্চ। দর্শক গ্যালারিতে যেন এক-কাতারে মিলেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মঞ্চের দিকেই অবিরাম মনোযোগ সবার। তখন মঞ্চস্থ হচ্ছিল নাট্যকার মামুনুর রশিদ রচিত ‘রাষ্ট্র বনাম’ নাটকটি। মন্ত্রমুগ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু সে গল্পের কথা কিছুটা বলা যাক।
‘নীলফামারির প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রাম ‘সোমজানি’। বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মতো এ গ্রামেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বহু বছর ধরে বাস করে আসছে। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের বিপদে যেমন সঙ্গী হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন উৎসবে মেতে উঠেছে একসঙ্গে। তবে তাদের এ সম্প্রীতি ভেঙে দিতে ওঠে পড়ে লাগে এক দুষ্কৃতকারী শক্তি। যাদের মূল লক্ষ্যই হলো ভিন্ন গোষ্ঠীর নিরীহ লোকদের গ্রাম ছাড়া করে যাবতীয় সম্পদ লুট করা। এ লক্ষ্যে ওই দুষ্কৃতকারীরা তাদের একজনকে খুন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর দায় চাপিয়ে মামলা করে। পরবর্তীতে দুষ্কৃতিকারীরা পুলিশ প্রশাসনকেও টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টকেও তারা মিথ্যা রিপোর্ট হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করে। নাটকের শেষ পর্যায়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অসত্যতা প্রকাশ পেলেও আদালত তা অগ্রাহ্য করে স্বজনহারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের দোষী সাব্যস্ত করে। আর এভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের অপশক্তির কাছে হেরে যায় সত্য শক্তি।’
কেবল ‘রাষ্ট্র বনাম’ নয়, এরকম আরও ১০টি নাটক আর সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় মেতে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ^বিশ^বিদ্যালয় (চবি)। নাট্যকলা বিভাগ আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আয়োজনের প্রতিপাদ্য ‘মুক্তির চেতনায় শিল্পীত সৃজন’ নির্ধারিত হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের উন্মুক্ত মঞ্চে টানা চতুর্থবারের মতো বার্ষিক নাট্যোৎসবের সমাপনি ঘটে শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি)।
মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকদের একজন ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুমন গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের কর্তব্য। তথাপি পুঁজিবাদ বা পেশি শক্তির কবলে পড়ে সুবিচার অধরা থাকে। নির্যাতিত হয় এদেশের প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। অথচ সবার সম্মিলিত লড়াইয়ে এ জাতির মুক্তি ঘটেছিল। রাষ্ট্র বনাম নাটকে সে বার্তাই প্রকাশ করেছেন নাট্যকার। আমি মনে করি সমাজের জন্য বিপ্লব দরকার। আর বিপ্লবের জন্য নাটক। নাটক সমাজের দর্পণ। তাই নাট্যকলা বিভাগের এই আয়োজন বিশ^বিদ্যালয় তথা এদেশের মুক্তি আর যুক্তির গতিকে ধারালো করবে।
চবির বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শর্মি দের কণ্ঠে ‘রাষ্ট্র বনাম’ নাটকের সুর। তিনি বলেন, স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন হতাশাজনক। একটি গোষ্ঠী সবসময় সংখ্যালঘুদেরকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। এ ধরনের নাটক আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিদের অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে শোচ্চার হতে আমাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করে। যার কৃতিত্ব নাট্যকলা বিভাগেরও প্রাপ্য।
নাট্যেৎসব সম্পর্কে নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি মো. শামীম হাসান বলেন, তীব্র শীত উপেক্ষা করেও দর্শনার্থীরা আমাদের আয়োজনে স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও সাউন্ড সিস্টেমে সমস্যা হওয়াসহ প্রতিক‚ল অবস্থা তো ছিলই। আমরা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও যৌক্তিক নাটকগুলোর মঞ্চস্থ করেছি। দর্শকদের সাড়া পেয়ে মনে হচ্ছে আমাদের থিয়েটারে নতুন দর্শনার্থী যোগ হয়েছে। আমরা বিশ^বিদ্যালয় অঙ্গনে নাট্যোৎসব আয়োজনের এ ধারা প্রতিবছর অব্যাহত রাখব।
উল্লেখ্য, তানভীর হাসান পরিচালিত ‘রাষ্ট্র বনাম’ নাটকে অভিনয় করেছেন নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সোলাইমান রাফি, নুসরাত জাহান, ধর্মরাজ, নিউটন চৌধুরী, সৌমেন দাশ, ফয়সাল উদ্দিন ইভান, তৌহিদল ইসলাম, শয়ন মজুমদার, ইসরাত উদ্দিন, মো. ওসমান গনি, তানভীর হোসেন, মো. কায়কোবাদ, মৌতি চক্রবর্তী, নওশিন জাহান এষা, ইফফাত আরা লামিয়া, জান্নাতুল ফেরদৌস নূপুর, অঙ্কন জ্যোতি মিত্র চাকমা, সানজিদা হক সুমনা, স্নিগ্ধা কর ও মনিষা চক্রবর্তী।
১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে যৈবতী কন্যার মন, মোহভঙ্গ, পূজোর সাজ, সোনার তরী, বাঁশি, রাত ভরে বৃষ্টি, রাষ্ট্র বনাম, নিষ্কৃতি, শ্যামাপ্রেম, লাল জমিন নাটক মঞ্চস্থ হয়।