ই-পেপার শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

সতর্কতা অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয়
প্রকাশ: বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ৬৬৪)
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এ সময়ের একটি বৈশি^ক মহামারী। প্রতিদিনই এর বিস্তার ও সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। থামার কোনো লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। আতঙ্কে ও উৎকণ্ঠায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে গোটা বিশে^। সঙ্কটময় এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞজনের সুপরামর্শ ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আমাদের সবার মেনে চলা উচিত। এটা মোটেও ঈমান ও তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয়। অসুস্থ অবস্থায় নবীজি (সা.) নিজে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং সাহাবিদেরকেও চিকিৎসা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘একবার নবীজির দরবারে কিছু বেদুঈন এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কি চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করব? তখন নবীজি (সা.) বললেন, তোমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ কর; কেননা মহান আল্লাহ একমাত্র বার্ধক্য ছাড়া সব রোগেরই ওষুধ সৃষ্টি করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৫৫)
প্রয়োজন হলে বৈধ উপায়-উপকরণ বৈধ পন্থায় অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু ভরসা রাখতে হবে একমাত্র আল্লাহর ওপর। তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসা করার অর্থ উপায়-উপকরণ পরিত্যাগ করা নয়। ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে’Ñ এ অজুহাতে বৈধ উপায়-উপকরণ গ্রহণ না করে বসে থাকা যাবে না। কর্মহীন বসে থাকার কথা আল্লাহ তায়ালা পার্থিব ব্যাপারেও বলেননি, আখেরাতের ব্যাপারেও বলেননি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত : ১০)। আয়াতের তাৎপর্য হলোÑ মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী কাজ করবে, কিন্তু ঈমান থাকবে আল্লাহর ফয়সালার ওপর। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘বিচক্ষণ ওই ব্যক্তি, যে নিজের কর্মের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। পক্ষান্তরে অক্ষম ওই ব্যক্তি, যে নিজের মন মতো চলে আর আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আশা পোষণ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)
যেমন কেউ ধারণা করল, ‘আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু! তিনি আমাকে মাফ করে দেবেন। সুতরাং আমল না করলেও কোনো অসুবিধা নেই।’ এই ব্যক্তি প্রকৃত তাওয়াক্কুল অবলম্বনকারী নয়। সে হচ্ছে অক্ষম ও নির্বোধ। তেমনি দুনিয়ার ব্যাপারেও যারা অলস ও কর্মবিমুখ থাকে, সাধ্যের ভেতরে এবং শরিয়তে যা বৈধ তা থেকেও বিমুখ, কিন্তু মুখে বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি; এরাও প্রকৃতপক্ষে তাওয়াক্কুল অবলম্বনকারী নয়। হাদিসের ভাষ্যমতে এরাও অক্ষম।
চলমান পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে সতর্কতা অবলম্বন না করার নাম তাওয়াক্কুল নয়। সাবধান থাকা চাই, উপায়-উপকরণ ও সতর্কতাকে অগ্রাহ্য করে আপনার অবহেলা ও অসতর্কতা যেন জাতির বিপর্যয় ডেকে না আনে! আপনার একটু অবহেলা ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে, আপনার পরিবার, আপনার স্বজনদের। এমনটি করা জঘন্যতম পাপ। অন্যের ক্ষতি সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহ কাউকে ছাড় দেওয়া নয়!
কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে তাওয়াক্কুলের অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) বনী ইসরাঈলদের নিয়ে অথৈ সমুদ্রের সম্মুখে এসে থমকে দাঁড়ালেন, পিছনে ধাওয়া করে আসছে ফেরাউন বাহিনী, যাওয়ার কোনো পথ নেই, আল্লাহ তায়ালা তখন হজরত মুসাকে (আ.) বললেন, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। (তিনি আঘাত করলেন) ফলে, তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ হয়ে গেল। (সুরা শুয়ারা, আয়াত : ৬৩)। আরও একটি ঘটনা দেখিÑ মিসরের তীহ প্রান্তরে (কারও মতে সীনা মরুভূমিতে) বনী ইসরাঈলের পানির প্রয়োজন দেখা দিলে আল্লাহ তায়ালা মুসাকে (আ.) বললেন, তোমার লাঠি পাথরে মার। তিনি লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করেন। তখন পাথর থেকে বারোটি ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। গোত্রও বারোটি ছিল। প্রত্যেক গোত্র নিজেদের ঝরনা থেকে পানি পান করত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আল্লাহ তায়ালা মুসাকে (আ.) লাঠি দিয়ে প্রথমে আঘাত করতে বলেছেন কেন? আল্লাহ কি হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠির আঘাত ছাড়া সমুদ্রকে বিদীর্ণ করতে এবং পাথর থেকে ঝরনা প্রবাহিত করতে সক্ষম নন? অবশ্যই সক্ষম। কিন্তু দুনিয়াতে আল্লাহর সাধারণ নিয়ম হলো, মানুষ তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে আর আল্লাহ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করবেন। আর হাদিসের বাক্যÑ ‘লা আদওয়া’, অর্থাৎ, ‘ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই’, (বুখারি : ৫৭০৭) এই হাদিসের সরল অর্থ করে সতর্কতা অবলম্বন ও উপায়-উপকরণ গ্রহণকে তাওয়াক্কুল বা ঈমান পরিপন্থি বলার সুযোগ নেই। ‘ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই’Ñ হাদিসের এভাবে সরল অনুবাদ করাটাও বিশুদ্ধ নয়। কারণ হাদিসটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা, এভাবে অনুবাদ করলে বোঝা যায়, ছোঁয়াচে রোগকেই ইসলাম অস্বীকার করছে। অথচ বাস্তবে এমনটি নয়। ইসলাম একে অস্বীকার করেনি। হাদিসের যথাযথ অনুবাদ এই, ‘রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রমিত হয় না।’ তা ছাড়া উক্ত হাদিসের বিপরীত অসংখ্য সহিহ হাদিস বিষয়ে আমরা কী বলব? মহামারী প্রসঙ্গে মহানবী বলেছেন, ‘যখন তুমি কোনো ভূখণ্ডে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার খবর শুনতে পাও তখন সেখানে প্রবেশ কর না। পক্ষান্তরে প্লেগ যদি তোমার অবস্থানস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে ওই জায়গা ত্যাগ কর না।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭২৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কুষ্ঠরোগী থেকে সিংহ দেখে পলায়নের মতো পালাও।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৯৭২২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যেন সুস্থ মানুষের থেকে দূরে থাকে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৯২৬৩)। অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, ‘কুষ্ঠ রোগীদের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থেক না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৫৪৩)
মহানবী (সা.)-এর কাছে বনি সাকিফ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন কুষ্ঠরোগী ছিলেন। তিনি নবীজির নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে আসছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে নবী (সা.) তার নিকট লোক পাঠিয়ে বলেন, ‘তুমি ফিরে যাও, আমি তোমাকে বাইয়াত করেছি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৫৪৪)। অতএব বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাগ্যের ওপর ভরসা করে চলমান মহামারী করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমগুলো ব্যবহার না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও কিছুতেই বিশুদ্ধ হবে না।
হাদিসে মহামারীর সময় ঘরে অবস্থানের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যা করোনাভাইরাসসহ সব প্রকার মহামারী-দুর্যোগ ও বালা-মুসিবতের সময় সতর্কতা অবলম্বনের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি একবার রাসুলুল্লাহকে (সা.) মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি।
উত্তরে তিনি বলেন, মহামারী হলো আজাব। যাদের ওপর ইচ্ছে আল্লাহ এ আজাব পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটি ঈমানদারদের জন্য রহমত বানিয়ে দেন এভাবে যে, কোনো বান্দা যদি মহামারী আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং সে সময় নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে, সাওয়াবের নিয়তে এ বিশ^াস বুকে নিয়ে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকদিরে যা চূড়ান্ত রেখেছেন, তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করতে পারবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে একজন শহীদের সমপরিমাণ সাওয়াব।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৩৪; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৬১৩৯)
হাদিস থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, মহামারী দেখা দিলে সওয়াবের আশায় বিশ^াস ও ধৈর্যের সঙ্গে যে ব্যক্তি ঘরে অবস্থান করবে, সতর্কতা অবলম্বন করবে সে শহীদের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে, যদি ওই মহামারীতে তার মৃত্যু নাও হয়।
আসুন আমরা নিজের ও জাতির স্বার্থে সচেতন হই, সুস্থ ও বেঁচে থাকার সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং বিশেষজ্ঞদের শরিয়তসম্মত পরামর্শ মেনে চলি। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন বিশ^ব্যাপী এ মহাপরীক্ষা দ্রুত উঠিয়ে নেন। আল্লাহ তায়ালা আমলের তওফিক দান করুন। আমিন।






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close