ই-পেপার শুক্রবার ৪ অক্টোবর ২০২৪
শুক্রবার ৪ অক্টোবর ২০২৪

শিক্ষা সংস্কার কমিশন কেন জরুরি
প্রকাশ: বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০২৪, ৪:২৪ এএম  (ভিজিট : ২৭৬)
পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির বার বার পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক, অভিভাবক এমনকি শিক্ষার্থীরাও ছিলেন দিশাহারা। অভিভাবকরা মূল্যায়ন পদ্ধতির বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সে থেকেও শিক্ষা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে পাঠক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা বৈষম্য দূর করার দাবি উঠেছে নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও পুলিশ বাহিনী- এই ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী এ কমিশনগুলো অক্টোবর মাসে কাজ শুরু করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিশনের রিপোর্ট পেশ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এ ছয়টি কমিশন গঠন করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের একটি রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে বলা যায়। তবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। সেসব ক্ষেত্রেও কমিশন গঠন করার দাবি উঠেছে। 

ইতিমধ্যে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলেছেন তথ্য উপদেষ্টা। খুব শিগগির এ কমিশন গঠন হবে বলে জানা গেছে। বিগত সরকারের সময় শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বিশেষ করে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। চাপিয়ে দেওয়া সেসব পরিবর্তনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি বেশিরভাগ মানুষ। শিক্ষা উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই শিক্ষাক্রমের উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।

পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির বার বার পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক, অভিভাবক এমনকি শিক্ষার্থীরাও ছিলেন দিশাহারা। অনেক অভিভাবক মূল্যায়ন পদ্ধতির বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সে বিবেচনা থেকেও শিক্ষা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে বলা যায়। ফলে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে পাঠক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা বৈষম্য দূর করার দাবি উঠেছে।

শিক্ষা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। তাই রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে শিক্ষা সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগের মাধ্যমেই একটি দেশ দক্ষ জনশক্তি বা মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটায়। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন একটি সময়োপযোগী শিক্ষাক্রম ও দক্ষ শিক্ষক। পাঠক্রমের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদেরও দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর জন্য শিক্ষা সংস্কার কশিমন গঠন করে এ দুটি বিষয়ে অতিদ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কলেজ পর্যায়ের সরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবি ছিল। সে দাবিতে তারা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবিই প্রধান। তবে তারা দীর্ঘদিন ধরে বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবি করে আসছেন। 
বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি এবং ঈদ বোনাস শতভাগ করার দাবি তাদের দীর্ঘদিনের। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড উন্নয়নের দাবি আছে। মোটা দাগে এসব দাবি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ও আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করা না হলেও পূরণ হয়েছে সামান্যই। শিক্ষাক্ষেত্রে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ হয়নি। বর্তমান সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল। ফলে এ সরকারকে বৈষম্য নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসন কিংবা সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  

শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার। এক্ষেত্রে পৃথক শিক্ষক নিয়োগ কমিশনের কথাও ভাবা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যে সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তাতে যোগ্য, দক্ষ ও নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নির্বাচন করা কঠিন। বিদ্যমান এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার বদলে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ও বেসরকারি। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিকে বেসরকারি বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ তারা সরকার অনুমোদিত কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন এবং বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এনটিআরসিএ-র মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ পাচ্ছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় বেতনস্কেলের অন্তর্ভুক্ত এবং শতভাগ বেতন, ইনক্রিমেন্ট ও বাড়িভাড়া-চিকিৎসা ভাতার একটি অংশ সরকারি কোষাগার থেকেই পান। এসব বিবেচনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেসরকারি বলার যৌক্তিকতা নেই। কলেজ শিক্ষকদের পদবিন্যাসে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক- এই চারটি পদসোপান থাকলেও এমপিওভুক্ত প্রভাষকরা শুধু সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত হতে পারেন। একই যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়ে অধিকতর যোগ্যতা-দক্ষতা, উচ্চতর গবেষণা ও চাকরিকাল বিবেচনায় কেন তারা সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হতে পারবেন না- এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। ফলে এই বৈষম্য নিরসন হওয়া জরুরি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বদলির দাবি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এ দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। 

শিক্ষা সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগ। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০০৫ অনুসারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জনের সনদ লাভ করতে হবে। ২০০৫ সালের পর এ সনদ লাভ করেই সবাই শিক্ষক হয়েছেন। বর্তমানে এনটিআরসিএ পিএসসির আদলে এমসিকিউ, রচনামূলক ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করে সরাসরি নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষমতা পেয়েছে এবং সে ক্ষমতাবলে ইতিমধ্যে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই পুরোনো বিতর্কিত পদ্ধতিই বহাল আছে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনা, অর্থ লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তুলনামূলক অযোগ্য প্রার্থীরাও প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভের সুযোগ পাচ্ছেন।
 
কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও আগের নিয়ম বহাল থাকায় ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষকদের মধ্য থেকে পদায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগ করা যেতে পারে। এটা করা হলে সরকারকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যেতে হবে না।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংস্কারের পাশাপাশি নিয়োজিত শিক্ষকদের দক্ষতা, যোগ্যতা, উচ্চতর ডিগ্রি ও চাকরিকাল বিবেচনায় নিয়ে একটি ন্যায়সংগত পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বিদ্যমান পদোন্নতি নীতিমালায় দক্ষতা, যোগ্যতা ও উচ্চতর ডিগ্রি বিবেচনা করা হয় না। শুধু চাকরিকাল বিবেচনায় নিয়ে আনুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ফলে শিক্ষকরা দক্ষতা, যোগ্যতা ও উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে নিজেকে পেশাগতভাবে যোগ্য করে গড়ে তোলার কোনো চিন্তাই করেন না। বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির পদ্ধতি চালু করলে শিক্ষকরা নিজেরাই পেশাগতভাবে যোগ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতনকাঠামোও সন্তোষজনক নয়। 

বাংলাদেশে শিক্ষার সব স্তরেই শিক্ষকদের বেতন বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। বেতন বাড়ালেই কেবল মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হবেন। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকতাকে কেউ প্রথম পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করে না। এর নানাবিধ কারণ আছে। শিক্ষকরা একদিকে বেতন ও পদোন্নতিতে পিছিয়ে আছে অন্যদিকে তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বলে কিছু নেই। মুখে যতই সম্মানজনক পেশা বলা হোক না কেন- বাস্তবে শিক্ষকতা কোনো আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হতে পারেনি। এ বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয় অপরিসীম। শিক্ষার কোন স্তরে কী ধরনের বৈষম্য আছে এবং সে বৈষম্য নিরসনের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন সময়ে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করলে সেখান থেকেও করণীয় নির্ধারণের ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা লাভ করা সম্ভব। দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে এযাবৎ যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, তার কোনোটারই সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। 

উপদেষ্টা মহোদয়ের এ বক্তব্যে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে শুধু পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদোন্নতি নীতিমালার সংস্কার প্রয়োজন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হলে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ লাগবে না বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এর সত্যতা যাচাই করে শিক্ষা জাতীয়করণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষা ব্যক্তির মৌলিক মানবিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সে অনুযায়ী এ সরকার একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- এমন প্রত্যাশা করছেন সাধারণ মানুষ।

লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close