দেশের সাধারণ মানুষের বলতে গেলে কোনো আশা-আকাক্সক্ষাই পূরণ হয়নি। তাদের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে তরুণদেরই নেমে আসতে হয়েছে রাজপথে। অনেকটা অভাবিতভাবে ঘটেছে আগস্ট বিপ্লব, যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে, দেশের আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তরুণরাই শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করেছে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অভূতপূর্ব বিজয় লাভের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেখা যাচ্ছে চারদিকে শুধু একটার পর একটা সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলে এখন এমন একটা সময় চলছে যখন প্রায় সবকিছুই নতুন করে গড়ে তুলতে হচ্ছে।
কারণ বিগত সাড়ে পনেরোটা বছর সবকিছু চলেছে এক কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনে। যখন দেশের সাধারণ মানুষের বলতে গেলে কোনো আশা-আকাক্সক্ষাই পূরণ হয়নি। তাদের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে তরুণদেরই নেমে আসতে হয়েছে রাজপথে। তারই ধারাবাহিকতায় অনেকটা অভাবিতভাবে ঘটেছে আগস্ট বিপ্লব, যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে, দেশের আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তরুণরাই শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করেছে।
ইতিমধ্যেই তাদের প্রখর বুদ্ধিবৃত্তি, মেধা আর যেকোনো পরিস্থিতিতে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারক্ষক্ষমতা তাদের সাধারণ মানুষের চোখে অসাধারণ করে তুলেছে। তাই দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে তারাও বসেছে এখন নেতৃত্বের আসনে। তারাই এখন আমাদের পথের দিশারি।
সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো দেশের আপামর জনগণ যখন কোনো শাসক ও তার শাসনব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারায় এবং সেই সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ক্রমাগত বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি হতে থাকে তখন তারা বাধ্য হয়েই একসময় রুখে দাঁড়ায়। এই বাস্তব সত্যটিই আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান ও তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ তথা হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।
দিনে দিনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে আর ক্ষমতাবান অসৎ ব্যবসায়ী এবং তাদের সিন্ডিকেটের কালো হাতের কারসাজিতে মানুষের জীবন একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। শুধু ব্যবসায়ী নয়,ওই সময়ে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়নি এমন কোনো আমলা, সরকারি অফিসের ছোট-বড় কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ এবং ক্ষমতাসীন দলের যেকোনো স্তরের নেতা খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।
লেখার শুরুর দিকে যে অদম্য সাহসী ও মেধাবী তরুণদের কথা বলছিলাম তাদের কথাই আবার পুনর্ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছেন, দেশের যুবসমাজের জীবন উৎসর্গ এবং অদম্য নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা জীবন দিয়েছে। তরুণদের এই স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তিনি বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না ও বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। আমাদের এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।
এদিকে যেখানে এখন বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টর, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সেক্টরের সংস্কার প্রয়োজন সেখানে বিভিন্ন সময়ে নানা সংগঠনের হাজারো দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে । একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি-দাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সরকার গঠনের ৪৬ দিনে সারা দেশে সর্বাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে হাজারখানেক দাবি জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে ষাটের অধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে চারশর কাছাকাছি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। বেশিরভাগ দাবির মধ্যে রয়েছে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং চাকরি স্থায়ীকরণ। এসব দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভুক্তভোগী ছাড়াও সুযোগ-সন্ধানীরাও রয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা ।
এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ দেশের চাইতে ব্যক্তিগত স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলোর গতি বুঝে বা না বুঝে স্থবির করে দিচ্ছেন। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে অসৎ ব্যবসায়ীদের কালো হাতের কারসাজি এখনও যে বন্ধ হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাজারে গেলেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বের সেই তথাকথিত সিন্ডিকেট প্রথা এখনও চালু রয়েছে। না হলে এই সময় এখনও কেন বিভিন্ন শ্রেণির চালের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে? কেন আমদানির পরেও ডিমের দাম কমছেই না। বিভিন্ন শাকসবজির দাম নানা অজুহাতে কিছুটা বেড়েই রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কাজ এখনও বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে শিল্পাঞ্চলগুলো বেশ কিছু দিন ধরে চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে শ্রমিকদের দাবি-দেওয়ার বেশিরভাগ মেনে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তারপরও শিল্পাঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা টহলে রয়েছেন।
অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, আমাদের দেশের যত উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে ও এই ধরনের দুর্নীতি ঘটেছে প্রধানত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে নেন নিজেদের জন্য। তারই উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি হাসিনা সরকারের পতনের পরে বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং আমলার বাড়ি থেকে বস্তা বস্তা টাকা উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় ।
তবে অনেকের ধারণা, এখনও আমাদের দেশে সবচেয়ে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে ব্যাংকিং সেক্টরে ও যার জন্য দায়ী প্রধানত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি। তাদের কারণেই হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেছে। পরে পাচার হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
এসব কারণে এখন ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘খেলাপি ঋণ’ বা ‘ক্লাসিফাইড লোন’। এই অনাদায়ি বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে আজ হিমশিম খাচ্ছে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং তথা অর্থনৈতিক সেক্টর। কোনোভাবেই যেন আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না ঋণের টাকা। ফলে সুদে-আসলে কয়েক মাসের মধ্যেই এই অঙ্গটি অভাবিতভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ।
সাবেক সরকারের আমলে তবু এসব প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যাংক লুটেরারা কখনো কখনো বিদেশে তাদের ‘সেকেন্ড হোমে’ থাকলেও মাঝেমধ্যে দেশেও থাকতেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর এদের সবাই এখন পলাতক। ফলে তাদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন দেশে তাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনার জন্য সেই সব দেশের সরকারের সহযোগিতা চেয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা সত্যিকার অর্থেই পড়েছেন বিপদে। এদের মধ্যে যাদের শিল্পাঞ্চলে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে যেগুলো শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বন্ধ হয়ে রয়েছে কিংবা অন্য কোনো ব্যবসা রয়েছে যেখানে নানা কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে তারা তাদের ঋণ শোধ করতে পারছেন না।
এ ক্ষেত্রে যদি সত্যিকার অর্থে বর্তমান সরকার কঠোরতা অবলম্বন করতে পারে তা হলে এই বিপুল পরিমাণ অনাদায়ি ঋণ আদায় করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে বড় বড় সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঋণ অনুমোদন ইত্যাদির জন্য দায়ী থাকবেন প্রধান নির্বাহী। যদিও বড় বড় সিদ্ধান্ত বোর্ডেই হয় এবং তা অনুমোদন দিয়ে থাকেন প্রধান নির্বাহী। ফলে সব কাজই সম্পাদিত হয় প্রধান নির্বাহীর স্বাক্ষরে।
এদিকে ঋণখেলাপিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন গভর্নর। এ জন্য ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য অনুসরণ করেই পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এখানে যে সমস্যা রয়েছে তা হলো সিআইবির ড্যাশবোর্ডে সরাসরি তথ্য আপলোড করার সুযোগ থাকায় যেকোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চাইলেই কোনো গ্রাহকের খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করতে পারে এবং অতীতে এভাবে অনেক ব্যাংক অনেক খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই ক্ষমতা পেয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে।
অভিযোগ আছে, দেশের অন্তত ২০০ জন আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বাড়তি সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে খেলাপি ঋণের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছিল। এখন তরুণরাই একমাত্র ভরসা। পথের দিশারি।
লেখক: শব্দসৈনিক ও কথাসাহিত্যিক
সময়ের আলো/জিকে