ই-পেপার রবিবার ৩ নভেম্বর ২০২৪
রবিবার ৩ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও অর্জন
প্রকাশ: শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪, ১:৪২ এএম  (ভিজিট : ৪২০)
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, সম্মানের পেশা এবং মর্যাদার পেশা। শিক্ষক নিবেদিত, সম্মানীয়, পূজনীয়, স্মরণীয় এবং চিরজীবন হৃদয়ে গেঁথে রাখার মতো গ্রহণীয়। ১৬৭ দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যের প্রতিনিধিত্বকারী এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল নামক আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের আহ্বানে শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩৬৫ দিনে এক বছর সেই বছর থেকে শিক্ষকদের জন্য একটা দিন বিরাট কিছু বৈকি। সেই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ইউনেস্কো মহাপরিচালক ড. ফ্লেডারিক এম. মেয়র প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের যুগান্তকারী ঘোষণা দেন। 

বাংলাদেশও সেই ঘোষণায় সমর্থন দেয়। শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও সাফল্যকে অটুট রাখতে ১৯৯৫ সাল থেকে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আমেরিকা শিক্ষক দিবস পালন শুরু করে ১৯৪৪ সাল থেকে আর ভারত ১৯৮০ সালের ৭ মার্চ শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। ইউনেস্কো কর্তৃৃক প্রতিবছরই একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দিবসটির তাৎপর্যসহ শিক্ষকতা পেশার অবদানকে সম্মানের সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়ার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষায় কণ্ঠস্বর : শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’। 

পৃথিবীতে যত সম্মানজনক পেশা শিক্ষকতা তার মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। শিক্ষক সমাজ গড়ার কান্ডারি। শিক্ষক সমাজের প্রাণ। জাতি গঠনে বা একটি সভ্য জাতি বিনির্মাণে শিক্ষকদের অবদান অপরিসীম। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে উপলক্ষ করে বিশ্বের সব শিক্ষকের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। শিক্ষক দিবসে সভা সমাবেশ, শোভাযাত্রা করে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েই দিবসকে উদযাপন বা বিদায় জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয় বলে আমি মনে করি। শিক্ষকরাও সামাজিক জীব। তাদের জীবনমানও সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এর জন্য দরকার চাকরি ও আর্থিক নিরাপত্তা। 

এসে যায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা নির্ধারণের অতীত এবং বর্তমান প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্রসঙ্গ। বিগত সরকারের আমলে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো করার কথা বলা হলেও তাদের দেড় দশকে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও পৃথক বেতন কাঠামোর দাবি অব্যাহত আছে। মাধ্যমিক, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো অন্যতম দাবিতে পরিণত হয়েছে। দাবি আদায়ে শিক্ষকদের সংগ্রাম বা আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৭৩ সাল থেকে যা আজও অব্যাহত আছে। আন্দোলন ছাড়া এমনি এমনি কোনো অর্জন শিক্ষকদের ঘরে আসেনি। সেই আন্দোলন কখনো রাজপথে কখনো টেবিল আলোচনায় কখনো কঠোর কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে। 

একসময় সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকদের এক পয়সাও দেওয়া হতো না। পাকিস্তান আমলে মাসিক ৫ টাকা দিয়ে অনুদান ১৯৭৩ সালে ৫০ টাকায় এসে ঠেকে। নতুন স্বাধীন দেশের শিক্ষকরা বেঁচে থাকার তাগিদে শিক্ষক সমাজ ১২০ দিন ধর্মঘট পালন করে। এসএসসি শিক্ষক নেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের দিয়ে। অবশেষে দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আলজেরিয়া সফরের প্রাক্কালে প্রফেসর এম. শরীফুল ইসলাম গং শিক্ষক নেতাদের ডেকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বলেন এবং সফর শেষে দেশে ফিরে সবার বেতন দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০ টাকার অনুদান ১০০ টাকা করে দেন এবং শিক্ষকদের রেশন কার্ড চালু করেন। তখন পিয়ন থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ সমান অনুদান পেতেন। ১০০ টাকা চলতে থাকল ১৯৭৮ পর্যন্ত। আবার শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন দেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি সরকারি সফরে ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন। 

ইন্দোনেশিয়ায় তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পরবর্তীকালে মন্ত্রী এম. শামসুল ইসলাম। তার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া পূরণে একটা কমিশন গঠন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ১৯৭৮ সাল থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক অনুদান দ্বিগুণ করে ২০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। 

শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করে শিক্ষা কমিশন ১৯৭৯ সালের ২৬ নভেম্বর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে ৫০ ভাগ ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৫০ ভাগ পেতে সময় লেগেছে ২৬ বছর। 

২০০৬ সাল থেকে দেশের শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেলের শতভাগ বেতন পাচ্ছেন, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের জানুয়ারি থেকে। জিয়া পরবর্তী ৫০ ভাগের দুবারে ২০ ভাগ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ, দুবারে ২০ ভাগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং ১০ ভাগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরশাদ ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা এবং স্কেল অনুযায়ী একটা ইনক্রিমেন্টসহ কল্যাণ ট্রাস্ট অধ্যাদেশ জারি করে ক্ষমতা ত্যাগের দুদিন আগে এক কোটি টাকার চেক প্রদান করেন। সেই কল্যাণ ট্রাস্ট ১৯৯৭ সালে চালু করা হয়। 

১৯৯৪ সালে শিক্ষক আন্দোলনের ফসল সহকারী শিক্ষকদের জন্য আট বছর চাকরি শেষে পরবর্তী স্কেলে একটা টাইম স্কেল সুবিধাসহ অনুদানের পরিবর্তে বেতনের সরকারি অংশ। ২০০৪ সালে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য দুটো খণ্ডিত উৎসব ভাতা শুরু হয়। জাতীয় বেতন কাঠামোর ২৫ শতাংশ শিক্ষক এবং ৫০ শতাংশ কর্মচারী। ২০০২ সাল থেকে চালু করা হয় অবসর সুবিধা। ২৫ বছর চাকরি শেষে শেষ ৭৫ মাসের বেতন। 

এককালীন এ প্রাপ্তি শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। অবসর সুবিধার পথিকৃৎ শিক্ষক বন্ধু প্রফেসর এম. শরীফুল ইসলাম। বিগত সরকার সরকারি কর্মচারীদের সমপরিমাণ বৈশাখী ভাতাসহ প্রতি বছর বেতনের ৫ ভাগ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে গেছেন। শিক্ষকদের এযাবৎ সব প্রাপ্তিতে সরকারে যখন যারা ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। যেসব শিক্ষক নেতার আন্দোলন, সংগ্রাম, দেন-দরবারে আমাদের যত অর্জন তাদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। 

২০০৬ সাল থেকে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট মহাসচিব হয়ে যে দাবিগুলো নিয়ে আমি মাঠে-ময়দানে পত্র-পত্রিকায় লিখে যাচ্ছি বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে সামনে রেখে আবারও তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। ৫ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে জহুর হলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আয়োজনে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আলোচনায় অনেকটা ঠাঁই পাবে বলে আমি আশা করি।

শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। সরকারি শিক্ষকদের সমপরিমাণ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা দিতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মতো শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর করে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদা নির্ধারণ করতে হবে। প্রেষণে বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োগ চালু করতে হবে। যেমন বিগত চারদলীয় জোট সরকার বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছিল পাতার হাট ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপালকে। চাকরি বদলিযোগ্য করতে হবে। অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ তহবিল পুনর্গঠনসহ তিন মাসের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরকালীন পাওনা পরিশোধ করতে হবে। সব দাবির সমাধান চাকরি জাতীয়করণ।

সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন


সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close