জুলাই অভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে দুটো ঘটনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আপামর জনতাকে একযোগে টেনে নিয়ে আসে রাজপথে। এক. শেখ হাসিনা কর্তৃক আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেওয়া; দুই. আওয়ামী লীগের পেটুয়া বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সহিংসতায় আন্দোলনকারীদের প্রাণহানি। এই দুই ঘটনার পর দিনকে দিন আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে, প্রায় প্রতিদিন মানুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়াতে আন্দোলনকালে প্রচুর জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনাও ঘটে। পুলিশের গাড়ি, থানা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ধরনের সহিংসতা, যাকে আমরা বলছি আন-আর্মড কালেক্টিভ ভায়োলেন্স, আমাদের দেশের বা ভারতবর্ষের আন্দোলনের ইতিহাসে মোটেও আচানক কোনো বস্তু নয়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাম্প্রতিক আন্দোলনকারীদের এই ধরনের ‘জ্বালাও-পোড়াও’ নিয়ে যে বয়ান হাজির করেছে, তাতে যেমন পূর্বোক্ত রাষ্ট্রীয় বয়ানের মিল রয়েছে, তেমনি কিছু নতুনত্বও রয়েছে। একইভাবে নতুনত্ব রয়েছে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ধরন-ধারণেও।
রাজপথে ‘জ্বালাও-পোড়াও’
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে আগুন কারা দিয়েছে তা নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা জুলাই মাসজুড়ে রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খেয়েছে। কিছু কিছু স্থানে আগুন দেওয়ার সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই জড়িত বলে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল। অন্যদিকে ত্বরিতগতিতে যেভাবে কয়েকটি স্থাপনার ভাঙচুরকে সিনেম্যাটিক স্টাইলে (কল্পনা করুন ভাঙা গ্লাসের সামনে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য) প্রপাগান্ডার হাতিয়ার বানানো হয়েছে, তাতে খোদ আওয়ামী লীগের দিকেই ভাঙচুরের আঙুল তোলার অবকাশ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলো না? এটি কারা করেছেন বা কে দায়ী, এ ধরনের আলোচনাতে যাচ্ছি না, আমি উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ধরে নিচ্ছি, আন্দোলন চলাকালে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিপরীতে এটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই ছিল।
এমন জ্বালাও-পোড়াওর ঘটনার পর সরকারি মহল থেকে শুরু করে বিদ্বৎসমাজ পর্যন্ত বলা শুরু করেছেন, আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা, কিন্তু এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করছেন শিক্ষার্থীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে আন্দোলনের নামে কিছু দুষ্কৃতকারী অথবা তৃতীয় পক্ষ (আওয়ামী বয়ান অনুযায়ী এই তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে তাদের বিরোধী রাজনৈতিক দল, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী)। সে ভাষ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা ‘কোমলমতি’, ফলে তারা এই ধরনের সহিংসতায় যোগ দিতে পারেন না এবং সরকার আসলে এসব দুষ্কৃতকারীদের দমন করেছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই। এমনকি খোদ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম জুলাই মাসের ২৬ তারিখ যে প্রবন্ধ লিখেছেন, সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরও জ্বালাও-পোড়াও নিয়ে সরকারি বয়ানের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন।
কিন্তু এই যে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট বা জ্বালাও-পোড়াও দেখে আঁতকে উঠলেও ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, পাকিস্তান আমলে যতগুলো আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের উল্লেখ মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবশালী ইতিহাস চর্চাতে পাওয়া যায়, সেগুলোতেও এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াও খুব সাধারণ প্রবণতা ছিল। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন, সরকার বাধা দিয়েছে, ফলস্বরূপ জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে। আমাদের ইতিহাসে এমন কোনো আন্দোলন পাওয়া যাবে না, যেখানে জ্বালাও-পোড়াও ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যেমন, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নিয়ে সরকারি প্রেসনোটটা দেখা যেতে পারে : ‘গতকল্য সকাল হইতেই ঢাকা শহরের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও হাঙ্গামা শুরু হয়। হাঙ্গামাকারী ও হুজুগ-প্রিয় তরুণদের সহিত মিলিত হইয়া ছাত্রগণ রাস্তায় চলাচলকারী প্রত্যেকটি গাড়ির গতিরোধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দুষ্কৃতকারীগণ ছাত্রদের সহিত মিলিত হয় এবং হাঙ্গামা শুরু করে।’
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যে ‘শান্তিপূর্ণ’ ছিল না তা তো প্রায় সব ইতিহাসবিদই বিভিন্নভাবে আমাদের জানিয়েছেন। মওলানা ভাসানীকে নিয়ে সে সময় টাইম ম্যাগাজিন প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ নামে। সম্প্রতি মহিউদ্দিন আহমদ এক লেখাতে জানাচ্ছেন, ‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কালে ঢাকায় তিন-চারজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যে গেস্ট হাউসে ছিলেন, সেখানে আগুন দেওয়া হয়েছিল, দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজের অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছিল।’
হায়দার আকবর খানের বিবরণীটা পড়ে দেখুন : ‘মার্চ মাসে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকটি থানায় জনগণ আক্রমণ করে বন্দুক লুট করে। কিন্তু তেমন ঘটনা খুব বেশি নয়। গ্রামে গ্রামে তহশিল অফিসে জনগণ আগুন দেয়। কয়েকটি অঞ্চলে গরু চোরদের ধরে অথবা সাধারণভাবে খুব ঘৃণিত ব্যক্তিদের ধরে প্রকাশ্যে গণআদালত করে বিচার করে জবাই করা হয়েছিল।’ এই তাৎক্ষণিক বিচার নিয়ে তৎকালে দি গার্ডিয়ান লিখেছিল :There are reports of setting up in parts of Pakistan People. S. courts which were meting out instant executions to score of wrong doers before mobs of widely applauding peasants.
যদিও এই একেবারে অহিংস কায়দায় চলতে থাকা আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে আদতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে হতাহতের প্রতিক্রিয়াতে, তবু অদ্ভুতভাবে ‘হত্যাযজ্ঞে’র প্রিটেক্সট হিসাবে একে হাজির করা হয়েছে। অর্থাৎ যা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়াতে, তাকে দেখানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার কারণ হিসেবে। শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারি বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এই জ্বালাও-পোড়াওকে যেভাবে হত্যাযজ্ঞের প্রিটেক্সট হিসেবে উল্লেখ করছেন তার সঙ্গে একাত্তরের ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের হুবহু মিল রয়েছে। ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ থেকে শুরু করে পুরো ৯ মাস পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের প্রিটেক্সট হিসেবে মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ধ্বংসযজ্ঞ ও আইন-অমান্যকে চিহ্নিত করেছিল। এমনকি নব্বইয়ের গণআন্দোলন বা নব্বই পরবর্তীতে শেখ হাসিনার বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথের জ্বালাও-পোড়াও ছিল অতীব সাধারণ ঘটনা।
অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসের আলোকে যদি আমি জুলাই অভ্যুত্থানকে বিবেচনায় নেই, তা হলে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় এই জ্বালাও-পোড়াও মোটেও কোনো হঠাৎ নয়। আমাদের ইতিহাসে, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজপথে নামা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে সহিংস হয়ে ওঠা, একেবারে রাজনীতি নামক বিষয়টার সঙ্গেই জড়িত। আমি বলছি না যে, জ্বালাও-পোড়াওই গণঅভ্যুত্থান, বরঞ্চ বলছি জনগণের অসন্তোষ যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেয়, তখন সেখানে এ ধরনের সহিংস উপাদান থাকেই।
অন্তত ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে। ভারতবর্ষে রাজনীতির নামে এ ধরনের আইন ভঙ্গের সহিংস ঘটনা নিয়ে দীপেশ চক্রবর্তী যেমন বলছিলেন, The incidents are a large part of what takes place today not just in the name of politics, but rather as the very stuff of politics itself.
রাজপথের যেকোনো আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক হলো বা হচ্ছে কি না তা নিয়ে ক্ষমতাসীন বা রাষ্ট্রীয় বয়ান খুব তৎপর থাকে। এই নিয়মতান্ত্রিক বলতে কী বোঝানো হয়, তা কখনোই পরিষ্কার করে বলা হয় না। অনুমান করি, মানববন্ধন বা আলোচনা সভা বা বিশেষ কোনো মোড়ে কিছুক্ষণের জন্য প্রতিবাদ সভা আয়োজনকেই নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মতো ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কোনো আন্দোলন দিনশেষে নিয়মতান্ত্রিক কায়দায় সম্ভব কি না তা নিয়ে কোনো বাতচিৎ করা হয় না। ফলে এখানে নিয়মতান্ত্রিক মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বয়ানের ভেতরে গিয়ে তার কোলে বসে আন্দোলনের ভণিতা করা।
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাতে যেখানে ন্যূনতম নির্বাচনের মাধ্যমে রেজিম বদলের সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রের বাতলে দেওয়া পথে আন্দোলন করা। আর যাই হোক, বিদ্যমান রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কাঠামো পরিবর্তনের লড়াই রাষ্ট্রীয় বাতলে দেওয়া নিয়মতান্ত্রিক পথে হওয়ার কথা ছিল না। উপরন্তু কোনো জনগোষ্ঠীকে যখন সহিংস কায়দায় শাসন করা হয়, তখন জনগোষ্ঠীর অভ্যুত্থানের মধ্যেও নিয়মবহির্ভূত সহিংস উপাদান জড়িত হয়ে পড়ে। যে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়াতে আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হলো, তার স্বরূপই বা কেমন ছিল, সেটির খোঁজ নেওয়াও দরকার।
রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও ‘নতুনত্ব’
আন্দোলনকালে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এক নতুন স্তরে প্রবেশ করলেও আওয়ামী শাসনকালে রাষ্ট্রীয় অপরাপর সহিংসতা থেকে ভিন্নভাবে এটি পাঠ করা সম্ভব নয়। এই রেজিমের সহিংসতাকে বোঝা যাবে তিনটি জিনিস দিয়ে : গুম, ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও গায়েবি মামলা। অর্থাৎ আইনি ও বেআইনি-এই দুই ক্ষেত্রে সহিংসতা দিয়েই বোঝা যাবে, কীভাবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গণপরিসর থেকে রাজনীতি ও সম্ভাবনাকে গায়েব করে দিয়েছিল। আমরা একে চিহ্নিত করেছিলাম ‘মারণ-রাজনীতি’ (নেক্রোপলিটিক্স) নামে।
আশিলে এম্বেম্বের ধারণা ব্যবহার করে আমরা বলেছিলাম যে, এ ধরনের রাষ্ট্রপ্রণালিতে আইনের শাসন, সহিংসতা এবং জরুরি অবস্থার ফারাক ঘুচে একাকার হয়ে যায়। জৈব রাজনৈতিক রাষ্ট্রে যেখানে মানুষের জীবন সার্বভৌম রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় অর্থাৎ রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে পরিণত হয়, মারণ-রাজনৈতিক রাষ্ট্রে হত্যা হয়ে দাঁড়ায় সার্বভৌম ক্ষমতার প্রধান চরিত্র। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের জীবনকে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে এনে সার্বভৌমত্বের ব্যতিক্রমী ক্ষমতার অংশ হিসেবে ‘হত্যাযোগ্য’ প্রাণ তৈরি করার শাসনপ্রণালি এ নয়; বরং কাঠামোগত হত্যাযজ্ঞকে শাসনপ্রণালির অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত করার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বন্দোবস্তই মারণ-রাজনীতি।
এ ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পাইকারি হারে large scale death হত্যা উৎপাদন করাই সার্বভৌম ক্ষমতার প্রধান কাজ। কাজেই মারণ-রাজনীতির মানে হলো হত্যাকারীর দোর্দণ্ডপ্রতাপের কাছে জীবনের পরাজয় (subjugation of life to the power of death)। একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী যেখানে জীবন নামক অপেক্ষাগারে মৃত্যু নামক ট্রেনে ওঠার অপেক্ষায় থাকে। এ রকম রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃত্যুই ‘নিয়ম’, জীবন ‘ব্যতিক্রম’।
রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদী একচেটিয়া সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে এ রকম উন্মোচিত নাঙ্গা জীবনের অধিকারীরাই আবার সমাজের জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-লৈঙ্গিকভাবে ভিন্নধর্মীদের ‘অপর’ বর্গে চিহ্নিত করে, বর্ণবাদী সার্বভৌম ক্ষমতার মতাদর্শ সমাজে পুনরুৎপাদন করে এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মতো বিস্তার ঘটায়। ফলে নাস্তিক-শিবির-সমকামী এমনকি রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াইরত নাগরিকও সার্বভৌম ক্ষমতার ‘অপর’ ও বধযোগ্য প্রাণ হিসেবে উন্মোচিত হয়।
আওয়ামী রেজিমের বিভিন্ন সময়ে নানা বর্গের মানুষকে যেভাবে বধযোগ্য আকারে হাজির করা হয়েছিল, প্রায়শই বধও করা হয়েছিল এবং বিভাজিত সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে এস্তেমাল করে সেই বধের রাজনীতির পক্ষে নানামুখী মহল থেকে সম্মতি উৎপাদন ও আদায় করা হয়েছিল, তার এক অনিবার্য পরিণতি আকারে দেখা দেয় জুলাই মাসের ম্যাসাকার/হত্যাযজ্ঞ। যখনই সমাজের কোনো বর্গের লোককে বধ করা হয়েছে, তখন কোনো না কোনো বর্গ তাতে সম্মতি দিয়েছে।
নাস্তিক বলে কাউকে মেরে ফেললে যেমন একদিকে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বিরোধী দলের কেউ নিহত হলেও উল্লাস প্রকাশ হয়েছে। বিগত পনের বছরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর খায়েশের ওপর যে নাগরিকের হায়াত-মউত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে জুলাই মাসের ম্যাসাকার।
আওয়ামী রেজিমের সামগ্রিক সহিংসতাকে টের না পেলে বোঝা যাবে না, কীভাবে একটা রাষ্ট্র তার হাজার খানেক লোককে মাত্র ২০ দিনে স্রেফ রাস্তাতেই মেরে ফেলে! যে ধরনের মতাদর্শিক ও আইনি ব্যবস্থা দ্বারা এখানে বধযোগ্য প্রাণ তৈরি করা হয়েছে এবং সিভিল সোসাইটি থেকে এর সম্মতি আদায় করা হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা ও সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে জুলাই মাসের রাষ্ট্রীয় সহিংসতা। হত্যা করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা বা নির্বিকার ভঙ্গিতে গুলি করা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেই মোবাইলে দেখিয়ে ‘একটা মরলে আরেকটা দাঁড়ায়’ বলা-এগুলো সম্ভব হয়েছে এই দীর্ঘদিনের বাস্তবতায়।
তবে আন্দোলনের বিশেষ মুহূর্তে এসে, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও তাদের বয়ানের ক্ষেত্রে দুটো অভিনব বিষয় দেখা যায়। প্রথমত নাগরিক আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার বা আকাশপথের ব্যবহার, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া ও ছররা গুলিতে চোখ আক্রমণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার এক নতুন পর্বে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলিতে চোখে আঘাত পেয়ে ১৭ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা নেন ৮৫৬ জন। তাদের মধ্যে ৭১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়; চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৫২০ জনের; দুই চোখ নষ্ট ১৯ জনের। এক চোখ নষ্ট ৩৮২ জনের। এ ধরনের ঘটনার নজির আমরা আরও দুটো অঞ্চলে দেখতে পাই : কাশ্মির ও ফিলিস্তিনে। কাশ্মির নিয়ে ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদন দেখুন : doctors at Srinagars Shri Maharaja Singh hospital have treated at least 446 patients with injuries sustained from being shot at with pellet guns, which have been used against protesters by Indian forces in the region.’ একইভাবে ইসরাইলি স্নাইপারদের দেখা যায় ফিলিস্তিনিদের চোখ বরাবর গুলি করতে।
রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ধরনের এ অভিনবত্বের পাশাপাশি সহিংসতা বিষয়ক রাষ্ট্রীয় বয়ানেরও নতুনত্ব আছে। মূল বয়ানের হদিস ইতিমধ্যে ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, সরকার রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রিটেক্সট হিসেবে আন্দোলনকারীদের কর্মকাণ্ডকে হাজির করেছে। অর্থাৎ দায়টা আন্দোলনকারীদের ওপর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের তরিকা ভিন্ন : তারা আন্দোলনকারীদের ‘কোমলমতি শিক্ষার্থী’ বলে ‘নিষ্ক্রিয় সত্তা’ বানিয়ে দিয়েছে। এক অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষ এই ‘নিষ্ক্রিয় সত্তাদের’ কাঁধে সওয়ার হয়ে জ্বালাও-পোড়াও করছে, ফলে এই হত্যাযজ্ঞের দায় সেই তৃতীয় পক্ষের। আমি বলতে চাচ্ছি, সহিংসতার সাফাই গাওয়ার এই যুক্তিপদ্ধতি বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন, তবে দুনিয়ার ইতিহাসে পুরোনো।
বর্তমানে যারা ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে একটু খোঁজখবর রাখেন, তারা এই ধারার যুক্তির সঙ্গে পরিচিত। ইসরাইলি বাহিনী একইভাবে দাবি করে, তাদের আসল টার্গেট হামাস। কিন্তু হামাস যেহেতু সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ‘হিউম্যান শিল্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছে, সেহেতু হামাসকে নিধন করতে গিয়ে সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও নিহত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের যুক্তিও একই ধারায় চলছিল/ বা আন্দোলন শেষে এখনও চলছে : যেহেতু অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, সেহেতু তৃতীয় পক্ষকে দমন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা মারা গিয়েছিলেন। অথবা যারা মারা গিয়েছেন সবাই তৃতীয় পক্ষ।
উল্লেখ্য, এই যে পুরো বয়ানে উপস্থিত তৃতীয় পক্ষ, যাদের উপস্থিতি যেকোনো উপায়ে বিনাশ করা যেতে পারে বলে সব মহলে এক ধরনের সম্মতি আদায় করে নেওয়া হয়েছে, এটিই হচ্ছে আওয়ামী লীগের সহিংসতা বিষয়ক বয়ানের সবচেয়ে বড় দিক। বিগত পনের বছরের আওয়ামী রেজিমের ‘মারণ-রাজনীতি’ ব্যতীত এটি বোঝা যাবে না।
আন্দোলনের পর অর্থাৎ শেখ হাসিনার পলায়নের পর সহিংসতার আরেক প্রস্ত ঢেউ দেশজুড়ে দেখা দেয়। সেটির ধরন-ধারণ নিয়েও আলোচনা জরুরি, তবে সেটি অন্যদিন।
লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট
সময়ের আলো/আরএস/