ই-পেপার রবিবার ৩ নভেম্বর ২০২৪
রবিবার ৩ নভেম্বর ২০২৪

কালান্তরের এক মহাপথিক
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২:০৯ এএম  (ভিজিট : ২৭৪)
শামসুর রাহমান অবিচল, কবিতার বিচ্ছুরিত আলোয়। যেন কালান্তরের এক মহাপথিক। তেমনিই আছেন। অনড় বৃক্ষ হয়ে, অনাদিকালের ছায়ামগ্নতায়। কবিতার রাজ্যে কবিতার সম্রাটের মতো। সমকাল পেরিয়ে কালের কণ্ঠ হয়ে, সময়ের বেষ্টনী ভেদ করে মহাকালের ব্যাপ্তিতে আছেন তিনি। জেগে আছেন সৃষ্টির ফাল্গুনে, মনন ও মেধার শিখরে। ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সম্ভবত ব্যাপ্তি ও বৈভবে অদ্বিতীয়। কবিতায় নিজস্ব ভুবন ও ঐশ্বর্যের অধিশ্বর। 

শুরুটা হয় শুরুর মতো। কবিতায় শব্দ, ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্পের অনবদ্য সম্ভারে। সেই সঙ্গে আধুনিক কলাকৌশল, বোধ ও মননের সমাহার। প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, নামকরণের মধ্যেই অন্যরকম একধরনের গভীর অর্থবোধ ও মননশীলতার ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেন তিনি জানান দেন- আসছি। এসেছেন, থেকেছেন, চলেও গেছেন। রেখে গেছেন স্বাক্ষর। অমোচনীয় কালিতে লেখা অনবদ্য পঙ্্ক্তিমালা। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর যেভাবে তার পিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন ভয় ও বুকভরা বিশ্বাসে। পরবর্তীতে তার চেয়েও বেশি কিছু তিনি করতে পেরেছিলেন। শোনা যাকে তার নিজের ভাষায়- সোনার বাংলা’য় আমার কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর আমি পত্রিকাটি আমার মায়ের হাতে দিয়েছিলাম তাঁর পুত্রের  কবিতাটি পড়ার জন্য। ইতিমধ্যে আমার বাবা ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমার বাবা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে  বললেন, ‘এসব আমি ঢের দেখেছি। পারবে সে হুমায়ূন কবিরের মতো কবি হতে?’ আমি আমার চরিত্রের বিরুদ্ধে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে বলে ফেললাম, ‘যদি আমি কোনোদিন কবি হই তাহলে হুমায়ূন কবিরের চেয়ে বড় কবি হবো।’ এই দুর্বিনীত বাক্য উচ্চারণ করার পর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াইনি, পাশের ঘরে চলে যাই। এই কাণ্ডে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, যে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলতেই কেন যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তাম। (ভূমিকা, কবিতাসমগ্র ১ শামসুর রাহমান, অনন্য)। এভাবেই শুরু তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার গল্প। পরবর্তীতে তা অর্থাৎ জীবনভর সৃষ্টির এক মহাউপাখ্যান। 

শামসুর রাহমানের কবিতা বিষয়, অনুষঙ্গ ও ব্যাপ্তির এক বিশাল বৈভব। তার কবিতা জীবন ঘনিষ্ঠতা, বৈচিত্র্যতা, সমকালীনতা বোধ ও শিল্পের অনন্য সম্মিলন। যেন কোনো কিছুই বাদ পড়েনি তার দৃষ্টিতে। নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপন করেও সমগ্র দেশ তিনি পরিভ্রমণ করেছেন অনায়াসে। নগর চেতনার কবি, স্বাধীনতার কবি, প্রেমের কবি নানা অভিধায় তাকে অভিষিক্ত করা হয়। আধুনিক কবিতা যা ত্রিশের কবিতায় প্রবলভাবে ধারণ করা হয়। প্রকরণগত সেই সব অনুষঙ্গ ধারণ করার পরেও তার নিজস্বতা, নির্মাণ কৌশল তার সৃষ্টির ভুবন আলাদা অবয়বে প্রতিষ্ঠিত। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলি, পথের কুকুর, বেনেবউ পাখি, দুঃখিনী বর্ণমালা, শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক, রবিঠাকুরের অজর কবিতা, কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সাকিনা বিবি, হরিদাসী সবকিছুই তার কবিতাজুড়ে। একই কবিতায় কখনো নগর ও লোকজ শব্দাবলির সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে, এরই মধ্যে মৃত্যুগন্ধময় শহরে যখন খুব/কুঁকড়ে থাকা কোনো শীর্ণ গলির ভেতর/ আঁধারের নাড়িছেঁড়া নবজাতকের/ প্রথম চিৎকার জেগে ওঠে,/ মনে হয়, স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী/ কবিতার মতো/ তুমুল ঘোষণা করে অলৌকিক সজীব সংবাদ।/ তার শুরুর দিকের কবিতাগুলোতে বোধ ও ব্যাপ্তির যে উদ্ভাস পরিলক্ষিত হয় পরবর্তীকালে তা আরও সম্প্রসারিত হয়।

প্রথমদিকের কবিতাসমূহে তিনি স্বপ্ন, বাস্তবতাকে রোমান্টিকতার আদলে প্রকাশে প্রলুব্ধ হন। এর সঙ্গে প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনের  টানাপোড়েন, মানবিকতা, বেগ-প্রতিবেগ, বিরোধ বড় হয়ে দেখা দেয়। মানবীয় আশা-আকাক্সক্ষা, জাতির স্বপ্ন, বাস্তবতা কবিতায় বিরাট অংশজুড়ে জায়গা করে নেয়। তার মনন, দৃষ্টির গভীরতা ও পর্যবেক্ষণে যাপিত জীবনের দেখা-না দেখা অনুষঙ্গসমূহ তিনি আশ্চর্য কুশলতায় কবিতায় তুলে ধরেন।

বিরূপ সময়, বিপন্নতায় দ্বিধাহীনভাবে তিনি তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কবি মানসের এ অনঢ় নীতিগত অবস্থান তার কবিতাকে মানবিকতার আদর্শে করেছে ঐশ্বর্যময়। এ প্রবণতা সৃষ্টির ধারায়  জাতীয় জীবন থেকে বৈশি^ক পরিমণ্ডলেও সমান্তরালভাবে পরিব্যাপ্ত। স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অপরিমেয় ত্যাগ, বেঁচে থাকার দুর্নিবার শপথ তার কবিতায় প্রাণময় হয়ে ওঠে সুগভীর ব্যঞ্জনায়। তুমি আসবে বলে ছাই হল গ্রামের পর গ্রাম।/ তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার/ ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।/ তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা-মাতার লাশের ওপর।/ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পটভূমিতে লেখা তার বেশ কয়েকটি  কবিতা যেমন সময়ের স্মারক তেমনি গভীর  প্রসারিত শিল্পচেতনায় অজর। এসব কবিতায় বর্ণিত দৃশ্যপট, মুখগুলো  আমাদের চেনাজানা পরিবেশ ও জনপদ থেকে আহরিত। এভাবে লোক জীবনের নানা  অভীক্ষা তার কবিতায় শব্দ ও শিল্পে পরিণত হয়েছে। 

শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম যেমন মানবিকতার আশ্রয়ে লালিত তেমনি সামাজিক বোধের দায়ের মধ্যেও আড়ষ্ট। কোনো কবিতায় কামার্ত বাসনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। এখানে অসংযত মনোভাবের চেয়ে নারীর মানসিক ও শারীরিক ভাষা, স্বরূপ উন্মোচনের ইচ্ছাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার বিচিত্র অনুভব, অন্তহীন শিহরণে তিনি রোমাঞ্চিত। মানব হৃদয়ের একান্ত অনুরাগ ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামষ্টিক পর্যায়কে স্পর্শ করে। তিনি যখন বলেন, ‘যদি তুমি ফিরে না আসো,/ সুজলা বাংলাদেশের প্রতিটি জলাশয় যাবে শুকিয়ে,/সুফলা হবে মরুভূমির বালিয়াড়িতে,/ যদি ফিরে না আস। 
শামসুর রাহমানের কবিতা এভাবে ক্রমশ নিবিড় হয়ে ওঠে অপরিসীম পর্যবেক্ষণ, আশা, নিরাশা ও প্রখর জীবনবোধের ঘাত-প্রতিঘাতে। মানবিক অনুভূতিকে তিনি সহজেই কবিতায় ধারণ করেতে সক্ষম হন। কালের যাত্রা ধ্বনি শুনতে পান, মানবিক আর্তি বুঝতে পারেন। 

হেঁটে যেতে পারেন আলো-আঁধারিতে। আর এসবের পরিশীলিত শিল্প আঙ্গিকে তার কবিতা অজর হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন ত্রিশ-উত্তর বাংলা কবিতার প্রধান কণ্ঠস্বর।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close