ব্যালকনিতে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায় সে খুব ভালো। তাই মা চেয়েছিল তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। তার মতে, বাঙালি হয়ে জন্মেছে, আগে বাংলাটা ভালো করে শিখুক। পরে তাকে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করেছে। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাবার খিটিমিটি লেগে থাকে।
অনিকের দাদা-দাদি কেউ বেঁচে নেই। তাই তাদের গ্রামে যাওয়া হয় না। কখনো সেখানে গিয়ে খালি পায়ে হাঁটেনি অনিক। ঢাকায় বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ির ১১ তলায় থাকে ওরা। ভোর হতেই ঘুম ঘুম চোখে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হতে হয়। স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুম। আবার বিকালে বাসায় টিচার আসে। ছুটির দিন ছাড়া খেলার সময়ও পায় না অনিক। খেলাধুলাও সে মাঠে গিয়ে করে না। দিনকাল ভালো নয়, তাই ওর মা তাকে একা ঘর থেকে বেরোতে দেয় না। কম্পিউটার বা মোবাইলে গেম খেলেই তার ছুটির দিনগুলো পেরিয়ে যায়।
আজ অনিকের মন খারাপ। ওর বাবা আজ একটা কাজে গ্রামের বাড়ি গেছে। অনিক কখনো গ্রাম দেখেনি। তাই সে বাবার সঙ্গে যেতে চাইল। কিন্তু মা রাজি হলো না। কারণ দুদিন পরেই তার পরীক্ষা। বাবা যাওয়ার পর থেকেই অনিক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে অনেক বুঝিয়ে ডাইনিং রুমে নিয়ে এসে নাস্তা খেতে দিল। খাওয়া শেষে সে বিরক্ত মনে পড়ার টেবিলে গিয়ে পড়তে বসল।
এর কয়েক দিন পর বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরল অনিক। বাবা অফিস থেকে ফিরে ওর পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইল।
অনিক বলল, খুব ভালো হয়েছে। একটা প্রশ্ন কমন আসেনি। সেটা আমি বানিয়ে বানিয়ে দিয়ে এসেছি।
কী প্রশ্ন রে? মা জানতে চাইল।
ধান নিয়ে পাঁচটি বাক্য লিখতে বলেছিল।
তুই কী লিখলি?
অনিক গর্ব করে বলল, লিখেছি-
ধান একটি উপকারী গাছ। এর কাণ্ড অনেক মোটা ও শক্ত। বাবা আমাকে ধানগাছের কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে দিয়েছে। আমি প্রতিদিন সেই ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলি।
কী চমৎকার উত্তর হয়েছে, তাই না বাবা?
শুনে বাবা-মা দুজনই চুপ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর বাবা বলল, তোর পরীক্ষা শেষ কবে?
এই তো আর দুই বিষয় বাকি।
বাবা বলল, ঠিক আছে এখন তো হেমন্তকাল। তোকে ধান দেখাতে গ্রামে নিয়ে যাব। ওর মা কিছু বলতে চাইতেই থামিয়ে দিল বাবা। বলল, ভুলটা আমাদের। আমরাই তো তোকে মাটি থেকে দূরে রেখেছি। মাটি হলো মানুষের শেকড়। সেখানে যেতেই হবে। কীভাবে ধান চাষ হয়, মাছ চাষ হয়, ধান থেকে কীভাবে চাল হয় সব দেখাব তোকে।
আনন্দে নেচে উঠল অনিকের মন। পরীক্ষা শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল অনিক। কয়েক ঘণ্টা পর শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়ল ওদের গাড়ি। গ্রামের পরিবেশ কত শান্ত। কোলাহল নেই, গাড়ির কালো ধোঁয়া, হর্ন নেই। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে রাজহাঁসের দল। একটু পরেই ওরা দাদার বাড়ি পৌঁছে গেল। ঢোকার পথেই বিশাল একটা পুকুর। সেখানে মাছেদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। অনিক দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। যতই দেখে সে অবাক হয়ে যায়।
পুকুরঘাটে নামতে গিয়ে সে কী একটা প্রাণী দেখে ওপরে চলে আসে। বাবা বলল, ওটা কচ্ছপ। কিছু করবে না।
বিকালে ওরা ধানক্ষেত দেখতে গেল। ধান এখন আর সবুজ নেই। সোনালি রঙের কিছু পাকা ধান কাটা হয়েছে। চাষিরা ধান তোলার কাজে ব্যস্ত। অনিক কয়েকটা ধান হাতে নিল। দাঁত দিয়ে কেটে দেখল ভেতরে চাল! বাহ্, কী দারুণ ব্যাপার। কিন্তু ধানগাছ যে কাঠের নয়, ওটা দিয়ে ব্যাট বানানো যায় না সেটা ভেবেই ভীষণ লজ্জা পেল। বাবা বুঝতে পারল তার অবস্থা। এরপর ওরা সরষে ফুলের ক্ষেত দেখতে গেল। হলুদে ভরে গেছে সারা মাঠ। বাবার সঙ্গে অনেক ছবি তুলল সে। গোধূলির সময় বাড়ি ফিরতে দেখল গরুর পাল। এক সপ্তাহ গ্রামে থেকে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার শহরে ফিরে এলো অনিক। মনে মনে ঠিক করল, আবার স্কুল ছুটিতে সে গ্রামে যাবে।
মাইজদী, নোয়াখালী
সময়ের আলো/আরএস/