ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫
বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫

রাজনৈতিক দলগুলো এখন যা করতে পারে
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪, ১:২২ এএম আপডেট: ৩১.১০.২০২৪ ৮:৪১ এএম  (ভিজিট : ৪৫৩)

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাবে। বেশ কিছুদিন আগে সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে একজন উপদেষ্টা ২০২৫ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সাধারণত শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

সে হিসেবে এবং সেনাপ্রধান ও উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় ধরে নেওয়া যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মূলত নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা অন্তর্বর্তী সরকারেরও প্রধান দায়িত্ব। তবে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অভিন্ন নয়।

জামায়াতে ইসলামীকে সংস্কারের ওপর বেশি জোর দিতে দেখা যাচ্ছে। এতে নির্বাচন পিছিয়ে গেলেও দলটির খুব একটা আপত্তি নেই। এর কারণ হতে পারে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার দলটির অনেক শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিয়েছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল এবং সবশেষে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে তারা নতুন করে নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করে। দীর্ঘদিন কোণঠাসা অবস্থায় থাকা দলটি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে সময়ের প্রয়োজন। এসব কারণেই হয়তো জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নতুন করে দল গোছাতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ৬৪টি জেলায় নতুন করে আমির নির্বাচন করেছে। 
প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দফতরে তাদের সমর্থিত অনেকে জায়গা করে নিয়েছেন।

অন্যদিকে বিএনপিকে নির্বাচনের ওপর বেশি জোর দিতে দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েও বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। একটি অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সেসব ক্ষেত্রে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তারা ততটুকুই সংস্কার আশা করেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হয়েও বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। পরপর নির্বাচন বর্জনের ফলে জনসম্পৃক্ততায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন, গুম-খুন ও হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছিলেন অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থক। এখনও অনেকে কারামুক্ত হতে পারেননি। তবু আগামী নির্বাচনে জয়প্রত্যাশী বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। 

তারা চায় কিছু সংস্কার কাজ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য থাকুক। সব ক্ষেত্রে সংস্কার করার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলেও তারা মনে করেন। এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো জামায়াতে ইসলামী যতটা সময় দিতে রাজি বিএনপি ততটা সময় দিতে চায় না। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানও এই একই মাপকাঠি দিয়ে মাপা সম্ভব। 

কারণ তাদের কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে সহমত পোষণকারী, কেউ কেউ জামায়াতের সঙ্গে সহমত পোষণকারী। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার ততই বিতর্কিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করা শুরু হয়ে গেছে। 

সাড়ে সাত দশকের পুরোনো সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে ছাত্রলীগ গত দেড় দশকে যেসব অপকর্ম করেছে তার জন্য ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হতেই পারে। অনেকে আবার সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সমর্থন করছেন না। তারা মনে করছেন ছাত্রলীগে যারা চিহ্নিত অপরাধী তাদের বিচার করাটা সবচেয়ে জরুরি। 

সংগঠন নিষিদ্ধের মাধ্যমে কোনো শুদ্ধিকরণ হয় না। এতে সংগঠনের ভেতরে সংগঠনের নামে যারা অপরাধ করেছিল তারা পার পেয়ে যেতে পারে। আর একটি বিবেচনার বিষয় হলো ছাত্রলীগের একটি অতীত ঐতিহ্য আছে। বায়ান্নো, বাষোট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর-প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা কেউ অস্বীকার করবে না। 

বাংলাদেশ পর্বের ইতিহাসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল পরাশক্তি। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ছাত্রলীগকে দানবে পরিণত করেছিল। ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেওয়ার পর এসব দানবদের বিচারের আওতায় না এনে সংগঠন নিষিদ্ধ করার মানে হলো অপরাধীকে না ধরে অপরাধীর আস্তানাকে নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করা। আস্তানা পরিবর্তন করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের যারা আদর্শিক রাজনীতি করতে চায় তারা বঞ্চিত হবে। আর এ জন্যই কোনো রাজনৈতিক দল বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায় থেকে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সমর্থন করে না।

অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনমুখী নাকি সংস্কারমুখী কিংবা কতটা নির্বাচনমুখী আর কতটা সংস্কারমুখী-তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, মত-ভিন্নমত থাকতে পারে। এই বিতর্ক ও মত-ভিন্নমতের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। 

অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিগত ১৬ বছরের জঞ্জাল শেষ করে  নির্বাচন দিতে চান সে ক্ষেত্রে যে সময় প্রয়োজন হবে কোনো নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল সরকারকে সে সময় দিতে রাজি হবে না। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সাধারণ জনগণ ও ৪ কোটি নতুন ভোটার নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এটিই এখন মূল আলোচনার বিষয়। আলোচনায় যুক্ত আছেন শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও অস্পষ্ট বলে মনে করেন অনেকে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী ইতিবাচক কিছু কর্মসূচি হাতে নিতে পারে। নিবন্ধিত যেসব রাজনৈতিক দল এখনও নিজেদেসাংগঠনিক কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারেননি তারা এখন তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের আওতা বাড়াতে পারেন। যারা নিবন্ধনপ্রত্যাশী তারা তাদের প্রচারণা বাড়িয়ে দিতে পারেন। এতে নিবন্ধন পাওয়া সহজ হবে। 

যাদের কার্যক্রম সারা দেশে চলমান আছে তারা জেলায় উপজেলায় সমাবেশ করে এবং ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মিসভা করে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে এসব কার্যক্রম শুরু করেছে। দীর্ঘদিনের একদলীয় প্রভাব-বলয় থেকে বেরিয়ে আসা সাধারণ মানুষ এখন অনেকটাই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অবস্থায় আছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পারে। এতে তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।

ব্যাপক গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নির্বাচনমুখী করা গেলে সরকার নির্বাচনের দিকে মনোযোগী না হয়ে পারবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের এই কালপর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কাজ হওয়া উচিত জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠা। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। ক্ষমতায় গেলে তারা জনস্বার্থে কী কী কাজ করবেন সেটি পরিষ্কার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেই জনমনের এ আশঙ্কা দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। দলের সৎ, ত্যাগী ও জনবান্ধব নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। পেশিশক্তির রাজনীতি যে জনগণ প্রত্যাখ্যান করে-আওয়ামী লীগের পতন তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। 

জনগণ চায় সাম্য, ন্যায়-নীতি ও মানবিক মর্যাদা।অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে জনগণের কাছে সাম্য, ন্যায়-নীতি ও মানবিক মর্যাদার মূল্য অনেক বেশি। তাই দৃশ্যমান উন্নয়ন করেও আওয়ামী লীগ সরকার টিকতে পারেনি।

সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে তাদের আদর্শিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতা পরবর্তী সরকারকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এক ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে আর এক ফ্যাসিস্ট সরকারকে পুনর্বাসন করতে দেওয়া হবে না। আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। 

আর একটি বিষয় হলো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে সে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। সে হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো জনপ্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে অবস্থান করলে নির্বাচনে কাংখিত সুফল মিলবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং ব্যাপক গণসংযোগই এখন রাজনৈতিক দল গুলার কাজ।

পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close