হজরত ঈসা (আ.)-এর আগমনের কয়েকশ বছর আগের ঘটনা। সিরিয়ার আন্তাকিয়ার শহরতলিতে বসবাস করতেন একজন কাঠমিস্ত্রি। তার নাম হাবিব ইবনে ইসমাইল। ইসলামের ইতিহাসে তিনি ‘হাবিব নাজ্জার’ অর্থাৎ ‘কাঠমিস্ত্রি হাবিব’ নামে প্রসিদ্ধ। আন্তাকিয়া ছিল সে যুগে সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যে প্রসিদ্ধ এক জনপদ। আন্তাকিয়ার লোকজন মূর্তিপূজা ও অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত ছিল। হাবিব ছিলেন কুষ্ঠরোগী। অন্যদের মতো তিনিও রোগ থেকে মুক্তির আশায় বিভিন্ন প্রতিমার উপাসনা করতেন।
আল্লাহ তায়ালা হাবিব ও তার সম্প্রদায়কে সতর্ক করার ইচ্ছা করলেন। তিনি প্রথমে দুজন রাসুল পাঠালেন। তাদের নাম ছিল ‘সাদিক ও সদুক’। দ্বীনের দাওয়াত দিতে একবার তারা আন্তাকিয়া শহরের উপকণ্ঠে গেলেন। সেখানে তাদের দেখা হলো হাবিবে সঙ্গে। রাসুলরা তাকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ এবং আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দিলেন। হাবিব বললেন, ‘আপনাদের দাবি যে সত্য, তার কোনো প্রমাণ আছে কি?’ রাসুলরা বললেন, ‘আছে।’ তখন হাবিব কুষ্ঠরোগের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আপনারা কি আমার এ ব্যাধি দূর করে দিতে পারবেন?’ রাসুলরা বললেন, ‘হ্যাঁ! আমরা আমাদের রবের কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে রোগমুক্ত করবেন।’ হাবিব এ কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য! আমি জীবনভর দেব-দেবীর কাছে প্রার্থনা করছি। কিন্তু উপকার পাইনি। অথচ আপনাদের রব কীভাবে আমার কঠিন অবস্থা পাল্টে দেবেন? অতঃপর রাসুলদের দোয়ায় আল্লাহ তাকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য দান করলেন। ফলে তার ঈমান আরও দৃঢ়তর হলো।
রাসুল দুজন আন্তাকিয়াবাসীদের সত্য-সঠিক পথের দাওয়াত দিতেই থাকলেন। কিন্তু আন্তাকিয়াবাসী তাদের মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করল। তখন তাদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তৃতীয় আরেকজন রাসুল পাঠালেন। তার নাম ‘শামউন’। কিন্তু রাসুলগণের উপদেশমূলক প্রচার ও শিক্ষার জবাবে জনপদবাসী তাদের মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করতেই থাকল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা তো আমাদের মতোই মানুষ। আমরা তোমাদের কথা মানব কেন? আমাদের প্রতিপালক কারও প্রতি কোনো পয়গাম ও কিতাব নাজিল করেননি। তোমরা মিথ্যা বলছ।’ (সুরা ইয়াসিন : ১৫)
তাদের উসকানিমূলক কথাবার্তা শুনে কষ্ট পেলেও রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াত চালিয়েই গেলেন। তারা জবাবে বলতে লাগলেন, ‘আমাদের পালনকর্তা জানেন, আমরা তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি এবং মহান আল্লাহর পয়গাম সুস্পষ্টভাবে তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এখন মানা বা না মানা তোমাদের ইচ্ছা।’ (ইয়াসিন : ১৬-১৭)
তবু আন্তাকিয়াবাসীরা রাসুলদের কথা অমান্যই করতে থাকল। তখন আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার কারণে আন্তাকিয়া শহরে দুর্ভিক্ষ দিলেন। তারা আল্লাহর সতর্ক সঙ্কেত উপলব্ধি করতেই পারল না। উলটো রাসুলদের ‘অলক্ষুণে’ বলতে লাগল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা অশুভ বলেই আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছি।’ (ইয়াসিন : ১৮)
এক সময় তারা রাসুলদের হত্যা করার মনস্থ করল। এ জঘন্য চক্রান্তের খবর হাবিব নাজ্জার শোনামাত্রই সেখানে ছুটে এলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের লোকদের বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসুলগণের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় কামনা করেন না এবং তারা নিজেরাও সুপথপ্রাপ্ত।’ (ইয়াসিন : ২০-২৫)
হাবিবের কথায় আন্তাকিয়াবাসী কর্ণপাত করল না। বরং তার ওপর চড়াও হলো এবং উপর্যুপরি পাথর নিক্ষেপ করতে করতে হত্যা করে ফেলল। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হলো, ‘তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (ইয়াসিন : ২৬)
তখন হাবিব মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানত, ঈমান আনয়ন ও রাসুলগণের অনুসরণের কারণে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং চির সুখের জান্নাত দিয়েছেন; তাহলে তারাও বিশ^াস স্থাপন করত এবং সম্মানিত হতে পারত!’ (ইয়াসিন : ২৭)
আল্লাহ তায়ালা আন্তাকিয়াবাসীর চরম ধৃষ্টতার কারণে ক্রোধান্বিত হলেন এবং আসমানি আজাব পাঠানোর ইচ্ছা করলেন। আল্লাহর আদেশে জিবরাইল (আ.) শহরের দরজার দুই বাহু ধরে এমন বিকট আওয়াজ দিলেন, যার প্রবল প্রভাবে সবারই প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল। এক নিমেষেই পুরো আন্তাকিয়া জনপদ হয়ে গেল নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরি! (ইয়াসিন : ২৯)
(সুরা ইয়াসিন ১৩-২৯নং আয়াতের তাফসির : তাফসিরে ইবনে কাসির, মাআরেফুল কোরআন, সাফওয়াতুত তাফাসির অবলম্বনে)