দেশে বর্তমানে পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য রয়েছে মাত্র ১২টি পানি পরীক্ষাগার বা ল্যাবরেটরি। তবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিটি জেলার বিভিন্ন উৎসের পানির মান পরীক্ষা করা জরুরি হলেও এই পরীক্ষাগারগুলো যথেষ্ট ছিল না। তাই সবার জন্য নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৪ বছর আগে বাকি ৫২টি জেলায় পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে পরীক্ষাগারগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর কম্পিউটারসহ আনুষঙ্গিক সব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। তবে ৫১২ জনের জনবল কাঠামো চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ায় পরীক্ষাগারগুলো চালু করা যাচ্ছে না। নিয়োগবিধি অনুমোদনের পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। জনবল নিয়োগ দিয়ে আগামী জুনের মধ্যে পরীক্ষাগারগুলো চালু করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের পানির গুণগতমান পরীক্ষার জন্য যেসব ল্যাবরেটরি রয়েছে তার মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পরীক্ষাগারগুলো অন্যতম। সংস্থাটি আশির দশকে প্রথম পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করে। বর্তমানে অধিদফতরের অধীন ঢাকায় কেন্দ্রীয় পানি পরীক্ষাগারসহ ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, ঝিনাইদহ, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, গাজীপুর, বরিশাল এবং নোয়াখালীতে মোট ১২ পানি পরীক্ষাগার রয়েছে।
কোনো স্থানের ভূগর্ভস্থ পানির মান সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করা ও পানির উৎসগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য এসব পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষা করা হয়। তবে এসব পরীক্ষাগার থেকে অনেক জেলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় পানি পরীক্ষার জন্য নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহনে জটিলতা দেখা দেয়। এ কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালে নেওয়া ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৫২টি জেলায় নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি করার পর ইতিমধ্যে ল্যাবরেটরিগুলোতে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার এবং ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। টিউবয়েলের পানিতে আর্সেনিক আছে কী না তা পরীক্ষায় ৪৫০ টাকা, পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় সোডিয়াম ক্লোরাইড আছে কী না পরীক্ষার জন্য ৪৫০ টাকা এবং আয়রন পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা ফি দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মূল কাজ শেষ। এখন কার্যক্রম চালু করার জন্য নতুন ল্যাবরেটরির প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনকে কিছু জনবলের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জনবল কাঠামো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে।
গত জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৪ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।
দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অধিদফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের আর্সেনিক পরীক্ষার কিটসহ ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি এবং কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল সরবরাহ দীর্ঘ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছিল তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেট। গত বছর পানির গুণগতমান পরীক্ষা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে এই সিন্ডিকেটের বাইরে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে অংশ গ্রহণ করায় তাদের মনোপলি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা তাদের কর্মচারীদের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে একের পর এক অভিযোগ দিয়ে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট তৈরি করে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করার জন্য দরপত্রে অধিক কমমূল্যে দর দাখিল করে ক্রয় কাজে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অপপ্রয়াস চালায়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি যথাযথভাবে দরপত্র মূল্যায়ন করলে তাদের আসল তথ্য বেরিয়ে আসে। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের নামে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালায়। এ নিয়ে গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর বেশির ভাগ অভিযোগেরই কোনো সত্যতা পায়নি বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা। এসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের পানি পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য মালামাল প্রায় ১ বছর ধরে কিনতে না পারায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে কিছুটা দেরি হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মুন্সি মো. হাচানুজ্জামান জানান, পরীক্ষাগার নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ প্রকল্পের মূল কাজ শেষ হয়েছে। জনবল নিয়োগসহ পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হবে।
তিনি জানান, যশোর, গোপালগঞ্জ, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় নিকটবর্তী পরীক্ষাগারের জনবল দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে পানি পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ পানি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারছেন।
এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের দেশে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আওতা বাড়ার হার সন্তোষজনক হলেও সরবরাহ করা পানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রায়ই ব্যবহারকারীরা অনিশ্চয়তায় ভোগেন। তাই সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সারা দেশে স্থাপিত ল্যাবরেটরিগুলোর মাধ্যমে সারা দেশে পানি পরীক্ষা করা হবে। এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ এবং পরীক্ষিত বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন। ফলে জনসাধারণ নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাবে।
সময়ের আলো/জেডআই