এবার ঈদযাত্রায় নৌ ও রেলপথের যাত্রীরা অনেকটা স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারলেও ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে তিন মহাসড়কে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৪৮টি স্থান, ঢাকা-উত্তরবঙ্গের সড়কের ৫২টি, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ৬টি এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৪১টি স্থানের যানজট ভোগান্তির কারণ হতে পারে। তবে ঈদযাত্রায় সড়কে যানজট কমিয়ে যাত্রী ভোগান্তি লাঘবে ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে সাত দিন মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে অবৈধ স্ট্যান্ড, যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা, তিন চাকার যান চলাচল বন্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
পবিত্র ঈদুল ফিতরে এবার দুদিন বাড়তি ছুটি নিতে পারলে ১০ দিনের লম্বা ছুটি পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও লম্বা ছুটির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এবার বেশি মানুষ গ্রামমুখী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী গত ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়েন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি যান ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহনব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ লোক পরিবহন সম্ভব। তবে এবার ঈদের আগে লম্বা ছুটি থাকায় মানুষকে তুলনামূলক কম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। বিশেষ করে বড় কোনো বিপর্যয় না হলে লঞ্চ ও রেল যাত্রীরা স্বস্তিতেই ঘরে ফিরতে পারবেন। কিন্তু সড়কপথে দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন কাজের কারণে তিন মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে।
রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সাধারণত ছুটি বেশি হলে মানুষ বাড়িও যায় বেশি। আর ছুটি যতই থাকুক, ঈদের আগের দুই-তিন দিন চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে পোশাক কারখানা ছুটির পরই মূল চাপটা পড়ে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবারা লম্বা ছুটি পেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কম ছুটি পান। এ কারণে তারা ঈদের দুই থেকে তিন দিন আগেই বেশি যান। তিনি বলেন, ঈদের সময় চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন কম এবং যানজট থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের যেসব যানবাহন আছে, সেগুলো যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করার পাশাপাশি রেলের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তা হলে ঈদের সময় জনদুর্ভোগ কিছুটা হলেও কম হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবার ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখসহ ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে পারে। ঈদের আগের চার দিনে বাসে ৫ লাখ, মিনিবাসে ৩০ লাখ, ট্রেনে ৪ লাখ, প্রাইভেট কারসহ ব্যক্তিগত গাড়িতে ৩৫ লাখ, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ, লঞ্চে ৬০ লাখ, উড়োজাহাজে প্রায় ১ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির আশঙ্কা, এ সময়ে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় ‘নারকীয়’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই ঈদযাত্রা নিরাপদ ও ভোগান্তিমুক্ত করতে ঈদের আগে ছুটি দুদিন বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
গত ২১ মার্চ ঈদযাত্রা প্রস্তুতি নিয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সারা দেশে যানজটের ১৫৫টি স্থান নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৪৮টি স্থান, ঢাকা-উত্তরবঙ্গের সড়কের ৫২টি, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ছয়টি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৪১টি ও ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কের আটটি স্থান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৪৮টি যানজটপ্রবণ এলাকার মধ্যে রয়েছে কাঁচপুর সেতুর আগে-পরে বেশ কিছু ইউটার্ন, মেঘনা টোলপ্লাজা, বলদাখাল, গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, মাধাইয়া বাসস্ট্যান্ড, ইলিয়টগঞ্জ, সুয়াগাজী বাজার, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনের এলাকা, নন্দনপুর কোটবাড়ী ইউটার্ন, নাজিরা বাজার ইউটার্ন, নিমসার বাজার ইউটার্ন, চৌদ্দগ্রাম বাজার ও বিসিক মোড়।
ঢাকা থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের মহাসড়কে ৫৫টি যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মধ্যে রয়েছে বাইপাইল ও চন্দ্রা মোড়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় চার লেনের কাজ চলছে। ফলে পূর্ণ গতিতে যানবাহন চলতে পারবে না। এ ছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে থাকা ১১টি সেতু এবং ২টি সড়কে টোল আদায় করা হয়। টোল আদায় কেন্দ্রে যানবাহনের চাপ পড়লে যানজট লেগে যায়। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও দোলাইরপাড় মোড় এবং হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে টোল দেওয়ার সময় সৃষ্টি হওয়া যানজট দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য ভোগান্তির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায়ও লম্বা লাইন হলে ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন পরিবহন চালকরা। তবে দুর্ভোগ কমাতে ঢাকা বাইপাস (মদনপুর-ভূলতা-ভোগড়া), নবীনগর-চন্দ্রা, ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জয়দেবপুর ঢাকা (ভোগড়া)-চন্দ্রা-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা এবং ভাঙ্গা-বরিশালের মতো জাতীয় মহাসড়ক ও করিডোরগুলোর মেরামত বা সংস্কারকাজ ঈদের সাত দিন আগেই সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। একই সঙ্গে ঈদের আগে ও পরে এ জায়গাগুলো নজরদারির আওতায় আনার নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে পদ্মা সেতু কল্যাণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব জেলায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় লঞ্চের যাত্রী অনেক কমে গেছে। সাধারণত এ রুটের যাত্রীরা বাসের টিকেট না পেলে লঞ্চে আসেন। তবে ঈদের ছুটি লম্বা হওয়ায় এবার নৌপথে যাত্রীর চাপ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন লঞ্চ মালিকরা। আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না হলেও অনেক লঞ্চের অগ্রিম টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। ভোলা, পটুয়াখালী, রাঙ্গাবালী, বরিশাল রুটের বিলাসবহুল ও বড় লঞ্চগুলোর কেবিন বুকিং শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। লঞ্চের মালিক ও কর্মীরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা সড়কপথকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই আগের মতো আর লঞ্চে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষেও অগ্রিম টিকেটের তেমন চাহিদা নেই।
ঈদের আন্তঃনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকেট অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সব টিকেট অনলাইনে বিক্রি করার কারণে রেলস্টেশনে নেই কোনো চাপ। রেলের কর্মকর্তারা জানান, ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে আসন রয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০টি। এর সঙ্গে প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের মোট আসনের ২৫ শতাংশ টিকেট বিক্রি করা হবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য (আসনবিহীন)। আসনবিহীন টিকেট যাত্রার আগে কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হবে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একজন যাত্রী অগ্রিম যাত্রা ও ফিরতি যাত্রার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একবার করে টিকেট কিনতে পারছেন। প্রতিবার সংগ্রহ করতে পারছেন সর্বোচ্চ চারটি টিকেট। অগ্রিম টিকেট ও ফিরতি অগ্রিম টিকেট ফেরত দেওয়া বা রিফান্ড করা যাবে না। এবার মোট ২৪৮টি লোকোমোটিভ প্রস্তুত করা হয়েছে এবং অতিরিক্ত ৮৬টি বগি রেল বহরে যুক্ত হবে। ঈদ উপলক্ষে সব ট্রেনের সাপ্তাহিক বন্ধ বাতিল করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম জানিয়েছেন, এবার ঈদুল ফিতরে রেলযাত্রীদের কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না। এবার ট্রেনে টিকেট কালোবাজির করার সুযোগও নেই। সিডিউল বিপর্যয়ে প্রয়োজনে একটি বা দুটি বাড়তি রেক প্রস্তুত থাকবে। যাতে কোনো ট্রেন অতিরিক্ত দেরি করলে এ রেক দিয়ে সিডিউল বিপর্যয় রোধ করা যায়। তিনি বলেন, সিডিউল বিপর্যয়সহ নাশকতা ও দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোবাইল টিম কাজ করবে। সিগনালসহ সব ধরনের বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা রোধে আগে থেকেই রেললাইন চেকিং ও মেরামত করার কাজ শুরু করেছে রেলকর্মীরা।
সময়ের আলো/জেডআই